পুরাতন ধারা, সমানে চলিতেছে। যেমন অন্য বিষয়ে, যথা দলতন্ত্র অথবা সিন্ডিকেটতন্ত্রের ধারাবাহিকতায়, তেমনই সরকারি সদর দফতরে সস্তার দোকান খুলিবার জনমোহনতন্ত্রেও। গত শতাব্দীতে বাম আমলে রাজভবন হইতে সরকারি উদ্যোগে ‘ন্যায্য মূল্যে’ আলু বিক্রয় করা হইয়াছিল। পরবর্তী কালে, বোধহয় উন্নততর বামফ্রন্ট গঠনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই, ‘নিরাপদ’ কোয়েলের মাংস বিক্রয়ের সরকারি বন্দোবস্ত হইয়াছিল মহাকরণে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ বার সেখানে সরকার নিয়ন্ত্রিত দামে মুরগি ছাড়িলেন। বাজারে মুরগির দাম চড়িয়াছে, অতএব সরকারই বাজার হইয়া উঠিল। ক্রেতারা খুশি। ক্রেতারা ভোটদাতাও বটেন। পঞ্চায়েত নির্বাচনের ভোটদাতারা অবশ্য মহাকরণে মুরগি কিনিবার সুযোগ কমই পাইবেন, তবু, ‘কোল্যাটারাল বেনিফিট’ তো তুচ্ছ করিবার নহে।
সেই ইংরেজ আমল হইতেই বঙ্গজরা ‘সরকার মা-বাপ’ মন্ত্রে দীক্ষিত। স্বাধীন দেশেও ইহার ব্যতিক্রম হয় নাই। সরকার বলিতে এ রাজ্যে অধিকাংশ মানুষ নৈর্ব্যক্তিক ভাবে বিধিব্যবস্থা প্রদায়ী তন্ত্রকে বোঝেন না, সাকার নেতা-নেত্রীকে বুঝিয়া থাকেন। তিনি দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হইবেন, হাতে ধরিয়া খোসা ছাড়াইয়া ন্যায়ফলটি খাওয়াইয়া দিবেন, তবে না তিনি সরকার! সুতরাং ক্ষমতাসীনরা সুযোগ পাইলেই ন্যায়ফল বিতরণে প্রবৃত্ত হইয়া থাকেন। সেই পথ ধরিয়াই মহাকরণে সস্তা মুরগি আসিয়াছে। সম্পূর্ণ অবান্তর, অপ্রয়োজনীয় এই উদ্যোগ। মুরগির দাম বৃদ্ধির পিছনে যদি অসাধু ব্যবসায়ীদের চক্রান্ত থাকে, তাহার মোকাবিলার একমাত্র পথ আইন এবং প্রশাসনকে ব্যবহার করা। বস্তুত, সেই উদ্যোগও কতটা জরুরি বা কার্যকর, তাহা আগে ভাল করিয়া বিচার করা প্রয়োজন। এই ধরনের বাজারে চাহিদা ও জোগানের লীলায় দাম ওঠানামা করে, কখনও কখনও সেই গতি অস্বাভাবিক হইয়া থাকে, সচরাচর বাজারের ক্রিয়াতেই সেই অস্বাভাবিকতা সংশোধিত হয়। রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ যত কম হয় ততই ভাল। সরকার যদি একান্ত কিছু করিতে চাহে, তাহা যথাসম্ভব দূরে থাকিয়া করাই বিধেয়। তাহার পরিবর্তে সরাসরি বিকল্প বাজার সাজাইয়া বলিবার আয়োজন কেবল উদ্ভট নহে, বিপজ্জনক। ইহা নিছক তামাশার ব্যাপার নহে, ইহা সরকারি মানসিকতার অন্তর্নিহিত বৈসাদৃশ্যের এক উৎকট প্রমাণ।
সত্য ইহাই যে, আসল কাজ করিবার ইচ্ছা ও মুরোদ সরকারের নাই, সমস্ত মনোযোগ ও উৎসাহ অব্যাপারে কেন্দ্রীভূত। মহাকরণে বা অন্য সরকারি দফতরে যে কাজগুলি যথানিয়মে হইবার কথা, সেগুলি আগেও হইত না, এখনও হয় না, জনসাধারণ ধরিয়াই লইয়াছেন, যথা পূর্বং তথা পরং। কেবল মাঝে মাঝে নাটক অভিনীত হইবে, জনগণ তাহাতেই আমোদিত হইবেন। যেমন জনসাধারণ, তেমনই সরকার। আদর্শ আধুনিক সরকারের নৈর্ব্যক্তিক ভাবে বিধিব্যবস্থা নির্মাণ ও প্রয়োগ করিবার কথা এই সমাজ দাবিও করে না, পায়ও না। নানা ধরনের সার্কাস দেখিতে পায়, দেখে। মাঝে মাঝে যথা মুরগি রূপে খায়ও। |