আট মাস তা নিয়ে নাড়াচাড়া হয়নি। এমনকী বলা হচ্ছিল, সেটি নাকি খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না! স্বাস্থ্য দফতরের সেই রিপোর্টই এ বার ঠান্ডা ঘর থেকে বার করে তদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে রাজ্য গোয়েন্দা-পুলিশ (সিআইডি)-এর কাছে। সারদা-কাণ্ডের প্রেক্ষাপটে যে ঘটনার মধ্যে কিঞ্চিৎ ‘রাজনৈতিক মোচড়’ও দেখতে পাচ্ছেন প্রশাসনের একাংশ। বিষয়টির মূলে রাজ্য এড্স প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (স্যাক্স)-য় দুর্নীতির অভিযোগ।
২০০৭-২০১১ সালের মধ্যে (পশ্চিমবঙ্গে তখন বামফ্রন্ট জমানা) স্যাক্সে কয়েকশো কোটি টাকা নয়ছয় হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছিল, যাতে কিছু আমলার সঙ্গে নাম জড়িয়েছিল রাজ্যের কয়েক জন বাম নেতা ও প্রাক্তন মন্ত্রীর। তা খতিয়ে দেখতে স্বাস্থ্য দফতর রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তার নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি গড়ে। বছরখানেক বাদে, গত পুজোর ঠিক আগে কমিটি চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা দেয়। স্বাস্থ্য-সূত্রের খবর: রিপোর্টের ২২৯ নম্বর পাতায় একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পাশাপাশি রাজ্যের প্রাক্তন ও বর্তমান চার-পাঁচ জন আইএএস অফিসার এবং বাম সরকারের একাধিক নেতা-মন্ত্রীর বিরুদ্ধে সিআইডি-কে দিয়ে তদন্ত করানোর সুপারিশ ছিল।
কিন্তু পেশ হওয়ার পরে রিপোর্ট ধামাচাপা পড়ে যায়। স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা তখন জানিয়েছিলেন, রিপোর্টের ফাইলই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আট মাস বাদে সেটাই ‘খুঁজে বার করে’ সিআইডি’র কাছে পাঠানো হয়েছে। |
এবং এমন এক সময়ে, যখন সারদা-কাণ্ডে তৃণমূলেরও কিছু লোকের নাম জড়িয়ে যাওয়ায় রাজ্যের বর্তমান শাসকদল কিছুটা অস্বস্তিতে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনাটিকে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ মনে করছেন রাজ্য প্রশাসনের একটি মহল। এক কর্তার দাবি, “সারদা-কাণ্ডে কিছু তৃণমূল নেতার ভূমিকা নিয়ে বাম নেতারা শোরগোল শুরু করতেই চাপা পড়া রিপোর্ট বার করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সামনে পঞ্চায়েত নির্বাচন। বাম-আক্রমণ মোকাবিলায় এটি সরকারের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।”
বস্তুত ঠিক এই সময়ে স্যাক্স-রিপোর্ট সিআইডি’র হাতে দেওয়ার পিছনে প্রশাসনের একাংশ যেমন ‘রাজনীতির ছায়া’ দেখছে, তেমন ‘অভিসন্ধির অঙ্ক’ খুঁজে পাচ্ছে বিরোধীরাও। তাদের বক্তব্য: বিরোধী নেতাদের বিপাকে ফেলতে সিবিআই’কে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারও সিআইডি-কে একই ভাবে কাজে লাগাচ্ছে।
রাজ্য সরকার অবশ্য তা মানে না। তাদের দাবি: যা হয়েছে, নিয়ম মেনেই হয়েছে। স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তার কথায়, “স্যাক্সের দুর্নীতি নিয়ে স্বাস্থ্য দফতরই সিআইডি-তদন্ত চেয়েছিল। সেই মতো সিদ্ধান্ত হয়েছে। সিআইডি অনুসন্ধান-রিপোর্ট জমা দিয়েছে। তার ভিত্তিতে স্বাস্থ্য দফতর থানায় এফআইআর করবে। এর পরে মূল তদন্তপর্ব।” রাজ্যের স্বাস্থ্য-সচিব সতীশ তিওয়ারি বলেন, “সিআইডি ব্যাপারটা হাতে নিয়েছে। ওদের অনুসন্ধান-রিপোর্টের ভিত্তিতে এফআইআর দায়ের প্রক্রিয়া শুরু করেছি।” সিআইডি-র এক কর্তা জানান, “স্বাস্থ্য দফতরের প্রাথমিক তদন্তে যে যে আমলা, বাম নেতা ও প্রাক্তন মন্ত্রীর নাম উঠে এসেছিল, ওঁদের কয়েক জনকে বিশেষ ভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ বার তাঁদের বিরুদ্ধে এফআইআর করবে স্বাস্থ্য দফতর। তার পর সিআইডি মূল তদন্তে নামবে।
কোন কোন বাম নেতার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করেছে সিআইডি?
সিআইডি-সূত্রের খবর: তালিকায় বাম আমলের স্বাস্থ্যমন্ত্রী তথা বর্তমান বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র ও তাঁর স্ত্রীর নাম আছে। রয়েছেন প্রাক্তন মন্ত্রী মিনতি ঘোষ ও শ্যামল চক্রবর্তীর মতো নেতা-নেত্রী। স্যাক্সের প্রাক্তন তিন প্রকল্প-অধিকর্তার বিরুদ্ধেও অভিযোগ রয়েছে। অভিযুক্ত নেতারা কী বলছেন?
সূর্যকান্তবাবু আপাত ভাবে এতে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। “ওদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ কে সামলায়, তার ঠিক নেই! ওদের কে ভয় পায়? যত পারে, যাকে দিয়ে পারে, তদন্ত করাক। পণ্ডশ্রম ছাড়া কিছুই হবে না।” কটাক্ষ সূর্যবাবুর। সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তথা সিটু নেতা শ্যামলবাবুর মন্তব্য, “যা পারে করুক।” মিনতিদেবীর চ্যলেঞ্জ, “ওঁরা সিবিআই, সিআইডি যা খুশি করাতে পারেন। সিবিআইয়ে তো আবার মুখ্যমন্ত্রীর আস্থা নেই! ওঁর সিআইডি পছন্দ। আমরা স্বাগত জানাচ্ছি।” |