অধিগ্রহণের এক্তিয়ার নিয়ে বিতর্ক
তারা চ্যানেলের দায়িত্ব নেবে রাজ্য, মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্তে প্রশ্ন
সারদা-কাণ্ডের জেরে অস্তিত্বের সঙ্কটে ভুগতে থাকা তারা নিউজ ও তারা মিউজিক চ্যানেলকে বাঁচাতে এগিয়ে এল রাজ্য সরকার। এবং সরকারের তরফে আশ্বাস দেওয়া হল, অদূর ভবিষ্যতে দু’টি চ্যানেলই অধিগ্রহণ করবে রাজ্য। যে ঘোষণার অর্থ, এই প্রথম কোনও নিউজ চ্যানেল সরাসরি রাজ্য সরকারের হাতে আসতে চলেছে। কিন্তু টেলিকম নিয়ন্ত্রক সংস্থা টেলিকম রেগুলেটরি অথরিটি অফ ইন্ডিয়া বা ট্রাই-এর নিয়ম অনুযায়ী, সরকার এ ভাবে কোনও টিভি চ্যানেল অধিগ্রহণ করতে বা চালাতে পারে না। এই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক ভাবেই মুখ্যমন্ত্রীর দাবি ঘিরে কিছুটা সংশয় তৈরি হয়েছে।
বৃহস্পতিবার মহাকরণে সাংবাদিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, তারা নিউজ ও তারা মিউজিক চ্যানেল দু’টি অধিগ্রহণ করবে সরকার। চ্যানেল দু’টি কী ভাবে অধিগ্রহণ করা হবে, সেটা খতিয়ে দেখছে সরকার। কিন্তু যত দিন না তা হচ্ছে, তত দিন তাঁর ত্রাণ তহবিল থেকেই ওই চ্যানেলের কর্মীদের প্রতি মাসে ১৬ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হবে। মমতা বলেন, “মানবিক কারণেই ত্রাণ তহবিল থেকে এই অনুদান দেওয়া হবে।” মাসিক অনুদান দেওয়ার ফলে ওই কর্মীদের জীবিকার যে সমস্যা তৈরি হয়েছিল, তা তাঁরা কাটিয়ে উঠতে পারবেন বলে মুখ্যমন্ত্রীর দাবি।
এর আগে বিষমদ কেলেঙ্কারিতে মৃতদের পরিবারের জন্যও মমতা একই ভাবে ত্রাণ তহবিল থেকে ২ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন। তখনও জনগণের করের টাকায় এই ধরনের ঘটনায় সাহায্য করার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। এখন সারদা-গোষ্ঠীর দু’টি চ্যানেলের দায়িত্ব নেওয়ার ঘোষণার পরেও একই ভাবে প্রশ্ন উঠছে যে, যখনই যে কোনও সংস্থা বিপন্ন হবে, তার দায় কি সরকার এ ভাবেই নেবে?
মহাকরণে সাংবাদিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী। বৃহস্পতিবার। —নিজস্ব চিত্র
বৃহস্পতিবার মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পরেই নানা মহলে নানা জল্পনা শুরু হয়ে যায়। কোনও সরকার কেন কোনও নিউজ চ্যানেলকে নিজেদের তাঁবে রাখবে, এ প্রশ্ন যেমন ওঠে, তেমনই এটা সরকারের কাজ কি না, সেই প্রশ্নও তোলেন বিরোধীরা। প্রশাসনের একটি মহলের আবার প্রশ্ন, অর্থ সঙ্কটের কারণ দেখিয়ে কর্মীদের বকেয়া মহার্ঘভাতা (ডিএ) দিচ্ছে না সরকার। ইতিমধ্যে ২৮% ডিএ বকেয়া হয়েছে। তা হলে কোন যুক্তিতে মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে চ্যানেল চালাতে টাকা ঢালবে সরকার? ত্রাণ তহবিলের টাকা এ ভাবে খরচ করা যায় কি না, সেই প্রশ্নও উঠেছে। একই ভাবে প্রশ্ন উঠছে, সারদা-গোষ্ঠীর অন্য যে সব সংস্থা অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়েছে, তাদের ক্ষেত্রেও কি সরকার এ ভাবেই সিদ্ধান্ত নেবে?
কিন্তু তার থেকেও গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে অন্য জায়গায়। মুখ্যমন্ত্রী চ্যানেল অধিগ্রহণের যে ঘোষণা করেছেন, তা কত দূর সম্ভব। টেলিকম নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির নির্দেশিকা অনুযায়ী, কেন্দ্র বা কোনও রাজ্য সরকার কোনও টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার বা পরিবেশনার দায়িত্বে থাকতে পারবে না। এ প্রসঙ্গে প্রসার ভারতীর কথাও উঠেছে।
ট্রাই-এর বক্তব্য, সংসদে আইন পাশ করিয়ে গঠিত হওয়া প্রসার ভারতী কোনও ভাবেই সরকারি টিভি চ্যানেল নয়। ট্রাই-সূত্রের বক্তব্য, ব্রিটেনের বিবিসি বা জাপানের এনএইচকে-র মতো প্রসার ভারতীও ‘অটোনমাস পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্টার’।
মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার আইনগত ও নৈতিক ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। বিরোধী দলনেতা এ দিন বলেন, “শুধু ওই দু’টি চ্যানেল নয়। সারদা গোষ্ঠীর ১৩টি সংবাদমাধ্যমের কিছু বন্ধ, কিছু অনিয়মিত ভাবে চলছে। ওই সংবাদমাধ্যমগুলির কর্মীদের প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর সহানুভূতি নিয়ে কোনও প্রশ্ন তুলছি না। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে সমাধান করতে চাইছেন, সেটা কোনও রাস্তা নয়। সূর্যবাবুর প্রশ্ন, “রাজ্য সরকার নিজেরা চ্যানেল অধিগ্রহণ করে চালাতে পারে কি না, যথেষ্ট সন্দেহ আছে। প্রসার ভারতী হয়ে যাওয়ার পরে এই রকম পদক্ষেপ করা যায় কি?” তাঁর দাবি, তামিলনাড়ুতে এই রকম একটা মামলায় ট্রাই-এর মত রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে গিয়েছিল।
মুখ্যমন্ত্রী এই ঘোষণা করার আগে অর্থমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, তথ্য-সংস্কৃতি সচিব এবং দুই চ্যানেলের কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। পরে, তাঁর নির্দেশে অধিগ্রহণের পথে সরকারের সম্ভাব্য সমস্ত দিক খতিয়ে দেখে একটি ‘নোট’ তৈরি করেন তথ্য-সংস্কৃতি সচিব। সেটি পাঠানো হয় মুখ্য সচিবের কাছে। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য জানিয়েছেন, সাময়িক ভাবে চ্যানেল দু’টি পরিচালনার দায়িত্ব সরকার নিচ্ছে। পরবর্তী ধাপে অধিগ্রহণ করবে সরকার।
কী ভাবে অধিগ্রহণ করবে সরকার? মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “ভারতীয় সংবিধানের আর্টিকেল ৩১এ(বি) ধারা অনুসারে জনস্বার্থে এই দু’টি চ্যানেল পরিচালনার দায়িত্ব নিচ্ছি। তবে সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয়করণ নয়, গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল যে ভাবে ‘টেক ওভার’ করা হয়েছিল, সেই ভাবেই আমরা এটা নেব এবং চালাব।” তবে চ্যানেল দু’টির কোনও বকেয়া দায় (৬ কোটি টাকা) যে সরকার নেবে না, তা-ও পরিষ্কার জানিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি এ-ও জানান, চ্যানেলের কর্মীদের আদালতে একটি মামলা আছে। সেটি ওঁরা তুলে নেবেন বলে জানিয়েছেন। চ্যানেলটি অধিগ্রহণ করলে বিধানসভায় একটি বিল আনতে হবে বলে জানান মুখ্যমন্ত্রী। এবং আইনের জন্য রাষ্ট্রপতির সম্মতির প্রয়োজন।
মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষিত ওই ধারা অনুযায়ী, রাজ্য সরকার জনস্বার্থে একটি সুনির্দিষ্ট ও সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ওই চ্যানেল দু’টির পরিচালন ব্যবস্থাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে। এবং এটি যে হেতু সাময়িক ব্যবস্থা ও সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয়করণ নয়, তাই অধিগ্রহণজনিত ক্ষতিপূরণ ও অন্যান্য আর্থিক দায় সরকারের উপর বর্তাবে না। এ দিন সে কথাও জানান মমতা। প্রসঙ্গত, ‘দ্য গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল’ (টেকিং ওভার ম্যানেজমেন্ট) অ্যাক্ট, ১৯৭৫ বলে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ওই হোটেল পরিচালন ব্যবস্থাকে সরকার নিজস্ব নিয়ন্ত্রণাধীনে এনেছিল এবং এ জন্য সরকারকে কোনও ক্ষতিপূরণ দিতে হয়নি।
তারার এই দু’টি চ্যানেল ছিল সারদা-গোষ্ঠীর মালিকানাধীন। সারদা-কাণ্ডের পরে নিজেদের জীবিকারক্ষার আর্জি জানিয়ে সারদা-গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হন কর্মীরা। চ্যানেলের হাতে থাকা তহবিলের টাকা দিয়ে কর্মীদেরই চ্যানেল চালানোর নির্দেশ দেয় আদালত। এর প্রেক্ষিতে তৈরি হয় ‘তারা টিভি এমপ্লয়িজ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’। এদের মাধ্যমে কিছু দিন চ্যানেল চলার পরে তহবিল ফুরিয়ে আসে। তাই বাইরে থেকে তহবিল সংগ্রহ করার আবেদন জানিয়ে ফের আদালতে যায় অ্যাসোসিয়েশন। তারা জানায়, দু’টি চ্যানেল চালাতে মাসিক খরচ হয় ২ কোটি টাকা। এর মধ্যে কর্মীদের বেতন দিতে লাগে ২৬ লক্ষ টাকা। আদালত বাইরের থেকে অথবা সরকারের কাছে টাকা চাওয়ার অনুমতি দিয়ে চ্যানেল পরিচালনার জ্যন তিন সদস্যের কমিটি তৈরি করে দেয়। মহাকরণের খবর, এর পরেই সরকারের সঙ্গে কথা শুরু হয়। অবশেষে চ্যানেল দু’টি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত জানান মুখ্যমন্ত্রী। যার প্রথম পদক্ষেপ করা হল বৃহস্পতিবার।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.