পনেরো বছর বয়সে বিয়ে করতে চায়নি বলে খানাকুলের রৌশনারার গায়ে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল তার পরিবার। সতেরো বছর বয়সে বিয়ে করেও প্রাণে বাঁচল না বসিরহাটের রৌশনারা। শ্বশুরবাড়িতে লাগাতার মারধর-নির্যাতনের জেরে বুধবার মারা গিয়েছে সে।
প্রথম রৌশনারা পড়াশোনা করতে চেয়েছিল। নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছিল। বিয়েতে মত দেয়নি সে। অভিযোগ, তাই নিয়ে অশান্তির জেরেই খানাকুলের মেয়েটিকে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিল তার সৎমা আর বাবা। আপাতত এসএসকেএম হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই চালাচ্ছে রৌশনারা।
আর এক রৌশনারার বিয়ে নিয়েও পরিবারে দুশ্চিন্তার শেষ ছিল না। দরিদ্র পরিবার, তায় মেয়ের গায়ের রং কালো। বাবা ইছা মোল্লা আখের রস বিক্রি করে সংসার চালান। ঢালাও পণ-যৌতুকই বা দেবেন কী করে? যেনতেন প্রকারেণ মেয়েকে পাত্রস্থ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন ইছা। রৌশনারাও আপত্তি করেনি। মনে মনে গায়ের রংয়ের জন্য সে নিজেও নিজেকে অপরাধী ভাবত কি না, তা জানার আর কোনও উপায়ও নেই।
মাস চারেক আগে রৌশনারার বিয়ে হয়ে যায় বাদুড়িয়ার কুষডাঙা গ্রামে। স্বামী ওসমান গাজীও পেশায় আখের রস বিক্রেতা। কিন্তু অবস্থা রৌশনারার বাপের বাড়ির চেয়ে ভাল। খানিক জমি-জায়গাও আছে। অনেক খুঁজে-পেতে এই ওসমানকেই পাত্র পেলেন ইছা মোল্লা। মেয়ে কালো বলে এর আগে অনেকেই মুখ ঘুরিয়ে চলে গিয়েছিল। ওসমান রৌশনারাকে বিয়ে করতে রাজি, কিন্তু শর্ত একটাই। ভাল রকম পণ-যৌতুক দিতে হবে। ইছা তাতেই রাজি হয়ে যান।
কিন্তু যে শ্বশুরবাড়ি মেয়ে কালো বলে অতিরিক্ত পণ চায়, সেখানে মেয়ে ভাল থাকবে বলে কী করে ভাবলেন ইছা? সমাজতাত্ত্বিকরা বলছেন কালো রংকে খাটো করে দেখার প্রবণতা এখনও সমাজের বহু স্তরেই আছে। শুধু পাত্রপক্ষ নয়, মা-বাবারাও অনেক সময়ই কন্যাসন্তানের রং কালো হলে তাকে তার রূপের ঘাটতি বলেই মনে করেন। মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যালের কথায়, “শ্বশুরবাড়ির লোক যখন অতিরিক্ত পণ চাইছে এবং বাপের বাড়ি যখন তাতে রাজি হচ্ছে, তখনই একটা জিনিস পরিষ্কার যে, তাঁরা উভয়েই মেয়েটির ‘খামতি’ নিয়ে এক মত। বাপের বাড়িতেও মেয়েটি একটি বোঝা। বাবা-মা শুধু এই আশাটুকু করছেন, বাড়তি টাকা দিলে শ্বশুরবাড়ি মেয়েটিকে মেনে নেবে।”
রৌশনারার মৃত্যু প্রমাণ করে দিল, বাবা-মায়ের অনুমান ঠিক ছিল না। বিয়ের পরেও শ্বশুরবাড়ির দাবিদাওয়া ফুরোয়নি। দিন পনেরো আগেও জামাইয়ের চাহিদা মতো মোটরবাইক কিনে দিয়েছিলেন রৌশনারার বাবা। মনোবিদরা আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, মেয়েকে যাতে কোনও মতে বাপের বাড়ি ফেরানো না হয়, তা নিশ্চিত করতেই বিয়ের পরও শ্বশুরবাড়ির মন জুগিয়ে যেতে চায় মেয়ের পরিবার। রৌশনারার মৃত্যুর পর এখন হাহাকার করে ইছা বলছেন, “জামাইয়ের বাড়ি থেকে যখন যা চাইত, সাধ্য মতো দিতাম। ভেবেছিলাম তাতে যদি আমার কালো মেয়েটার উপরে ওদের রাগ একটু কমে। কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারলাম না।”
তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে, রৌশনারার উপরে নিয়ম করে নৃশংস অত্যাচার চালাত শ্বশুরবাড়ির লোকজন। কাপড় দিয়ে মুখ বেঁধে পেটানো হত। পাছে সে পালিয়ে গিয়ে প্রতিবেশীদের ডেকে আনে, সে জন্য মেয়েটির পোশাক-আশাক খুলে রেখে দিত তার স্বামী-শ্বশুর। রৌশনারার কালো রং তাকে তার শ্বশুরের কুনজরের হাত থেকে বাঁচাতে পারেনি বলেও অভিযোগ। পুলিশের কাছে ইছা জানিয়েছেন, ওসমানের আগে একটি বিয়ে ছিল। মারধর করায় সেই স্ত্রী ওসমানকে ছেড়ে চলে যান। কিন্তু রৌশনারার বিয়ের সময় সে কথা তাঁরা জানতেন না বলে দাবি করেছেন ইছা।
শ্বশুরবাড়িতে লাগাতার মারধরের জেরেই মেয়ে মারা গিয়েছে বলে পুলিশের কাছে রৌশনারার পরিবারের অভিযোগ। প্রাথমিক ভাবে পুলিশ নিজেও সে কথাই মনে করছে। বুধবার দুপুরে রৌশনারাকে স্থানীয় শিবহাটি হাসপাতালে ভর্তি করেছিল শ্বশুরবাড়ির লোকজন। পরে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বসিরহাট মহকুমা হাসপাতালে। সেখান থেকে আরজিকরে পাঠানোর পথেই মারা যায় মেয়েটি। পুলিশ রৌশনারার শ্বশুর আয়ুব গাজি ও শাশুড়ি হাসিনা বানুকে গ্রেফতার করেছে। স্বামী ওসমানের খোঁজ চলছে বলে জানিয়েছেন বসিরহাটের এসডিপিও অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়।
বসিরহাট পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে উত্তর ২৪ পরগনার এই মহকুমার ৯টি থানা এলাকায় পারিবারিক নির্যাতনের জেরে মারা গিয়েছেন তিনশোরও বেশি বধূ। রৌশনারা সেই তালিকাতেই আর একটা নাম বাড়ালেন। কালো মেয়ের কালো হরিণ চোখ এখন পাথর। ময়না-তদন্তের অপেক্ষায়। |