লোহার শিকের ডগা আগুনে রেখে লাল করে নিলেন। সেটা সামনে রেখে পিছন দিকটা সাবধানে ধনুকের ছিলায় লাগালেন। তিরের মতো ছুঁড়ে দিলেন অন্ধকারে। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরে ধুপধাপ শব্দ ভেসে এল। ভয়ে গুটিয়ে থাকা ছেলেরা হইহই করে আলপথ ধরে এগিয়ে গেলেন সামনে। চিত্কার করে জানালেন, ভয় নেই। মহাকাল পালিয়েছে।
মহাকাল অর্থাত্ হাতি। ডুয়ার্সের জঙ্গল সংলগ্ন এলাকায় প্রচলিত নাম। ওই নামে হাতিকে পুজো দেন বনবস্তিবাসীরা। কিন্তু ফসলের খেত থেকে বাঁচাতে ওই বুনোদের শরীরে গরম লোহার শিকের তির ছুঁড়ে দিতে ভুলছে না অনেকে। ওই তির কোনও বুনোর শরীরে বিঁধছে কিনা সেটা বলা মুশকিল। তবে ছেলেরা তির ছুঁড়তে দৌঁড়ে আশ্রয় নিচ্ছে জঙ্গলে। ময়নাগুড়ির গরুমারা জঙ্গল সংলগ্ন রামসাই এলাকার বিভিন্ন গ্রামে এ ভাবে হাতি খেদানোর কাজে নেমেছেন বাসিন্দাদের একাংশ। তাঁদের কয়েকজন জানান, পটকা ফাটিয়ে, টর্চ জ্বেলে এখন কাজ হয় না। বুনোরা উল্টে তেড়ে আসে। তাই অনেক ভেবে ‘গরম তির’ ছুঁড়ে দেওয়ার রাস্তা বার করেছেন। ঘটনার কথা শুনে জলপাইগুড়ি বন্যপ্রাণ-২ বিভাগের ডিএফও সুমিতা ঘটক বলেন, “খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। আমরা ওই কাজে জড়িতদের ধরার চেষ্টা করছি।” বন দফতরের বন সংরক্ষক (বন্যপ্রাণ) কল্যাণ দাস বলেন, “বিভিন্ন ভাবে হাতিদের উত্যক্ত করার ঘটনা নতুন নয়। এর ফলে উত্তরবঙ্গে বহু হাতি আহত হয়ে জঙ্গলে ঘুরছে।”
বনবস্তির বাসিন্দাদের সূত্রে জানা গিয়েছে, এর আগে দড়িতে বাঁধা কাপড়ের বল কেরোসিনে ভিজিয়ে আগুন দিয়ে ছুঁড়ে মারা হত। প্রথম দিকে হাতি ভয় পেয়ে পালিয়েছে। কিন্তু কিছুদিন যেতে না-যেতে ভয় ভেঙে যায়। আগুনে গোলা তুলে উল্টে ছুঁড়ে দিতে শুরু করে হাতি। গরম তির ব্যবহারের পরে বুনোরা অনেক সাবধান হয়েছে বলে দাবি বস্তিবাসীদের একাংশের। তির বলতে পুরনো ছাতার শিক, সাইকেলের স্পোক জোগার করে ছেলেরা পিটিয়ে এক মাথা সূচলো করে নেয়। অন্য দিকে জড়ানো হয় কাপড়। ছুঁড়ে মারার আগে তিরের ডগা খড়ের আগুনে লাল করে নেওয়া হয়। অনিল ওঁরাও নামে এক যুবক বলেন, “সরু হওয়ায় তিরগুলো ভাল ছোটে।” অন্ধকারে তাক করতে অসুবিধা হয় না! অনিল জানান, আকাশে চাঁদ না-থাকলে সমস্যা হয়। তখন আন্দাজে ছুঁড়তে হয়। জ্যোত্স্না থাকলে তাক করে মারেন।
এলাকার ধান খেতের পাশে সারি দিয়ে রয়েছে উঁচু খুঁটির উপরে তৈরি টং ঘর। বিকেলের পরে সেখানে উঠে অনেকে ধান পাহারা দেয়। তবে ছেলেরা ছোট দলে ভাগ হয়ে আশপাশে ছড়িয়ে থাকে। খড় পাকিয়ে দড়ির মতো তৈরি সলতের মাথায় আগুন জ্বেলে ঘাপটি মেরে বসে থাকে ঝোপের আড়ালে। আগুনে গুজে রাখে ছাতার শিক ও সাইকেলের স্পোকের তির। শব্দ পেলে সাঙ্কেতিক শব্দে একে অন্যকে সাবধান করে ওঁরা। হাতিরা কিছুটা এগিয়ে আসতে শুরু হয় আক্রমণ। এমনটা হলে যে সংক্রমণ ঘটতে পারে তা নিয়ে বনবস্তির প্রবীণদের সংশয় নেই। তাই অনেকে বিরক্ত। কিন্তু ঘটনার কথা বনকর্তাদের জানাতে পারছেন না। সেটা করলে ঘরের ছেলেরা বিপাকে পড়বে। তাই অসহ্য হলেও চুপ থাকতে বাধ্য হয়েছেন। |