সম্পাদকীয় ১...
মহামফস্সল
মার্কিন রাষ্ট্রদূত ন্যান্সি পাওয়েল কলিকাতায় একটি বক্তৃতায় বলিলেন, বাণিজ্য বা জাতীয় অর্থনীতি বা গুরুত্বপূর্ণ নীতি প্রণয়ন লইয়া কথা বলিতে গেলে অধিকাংশ মানুষের কলিকাতার কথা নহে, দিল্লি মুম্বই বেঙ্গালুরুর কথা মনে পড়িবে, কিন্তু গভীরতর অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনগুলি তো হইয়া চলে রায়পুর, রাঁচি, পটনা, দুর্গাপুর, শিলিগুড়ি বা কলিকাতায়। এই প্রথম কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি কূটনীতিক স্পষ্টাস্পষ্টি কলিকাতাকে দিল্লি মুম্বইয়ের সারি হইতে সরাইয়া রাঁচি দুর্গাপুর রায়পুরের পঙ্ক্তিতে ঠক করিয়া বসাইয়া দিলেন। সান্ত্বনা পুরস্কারের ন্যায় তিনি এই শহরগুলিকে দেশ-গতিবিধির প্রকৃত নির্ণায়ক বলিয়াছেন বটে, কিন্তু ইঙ্গিতটি ধরিতে অসুবিধা ঘটে না। কলিকাতার তাত্‌পর্য আজ ক্ষুদ্র শহরের তাত্‌পর্যের সহিত তুলনীয়। অবশ্য এই বদ্ধ জলার ন্যায় অকর্মা শহরটি যেখানে আবর্জনা উপচীয়মান, যানবাহন বিশ্ৃঙ্খল, দারিদ্র সম্মুখপ্রকট ও গতায়াত অবরোধসাপেক্ষ; যেখানে রাজনীতি সভ্যতাহীন, জনজীবন মস্তানভীত, দফতর নৈরাজ্যবিলাসী ও পরিকল্পনা বাস্তববিমুখ; যেখানে উদ্যোগের তুলনায় হুজুগ, বুদ্ধির তুলনায় বুকনি ও মৌলিকতার তুলনায় মধ্যমেধা উপাস্য বহু কাল তাহার গৌরব হারাইয়াছে, পড়িয়া আছে কেবল এক বায়বীয় অহমিকা অনুভবের অভ্যাস। যদি নিরপেক্ষ ভাবে কলিকাতার বর্তমান অবস্থাকে কেহ দেখিতে পারে, তাহা হইলে ক্ষুদ্র শহরের সহিত তাহার তুলনায়, শ্লাঘাই বোধ করিবে।
ক্ষুদ্র শহরগুলি ক্রমেই ভারতের মানচিত্রে উজ্জ্বল স্থান অধিকার করিতেছে। তাহাদের পথঘাট যানযোগ্য, বাণিজ্যক্ষেত্র বিস্তৃত, পরিকাঠামো উন্নয়নশীল, তাহারা উদ্যমের রথে সুপরিকল্পিত পথে অগ্রসর। ভারতীয় ক্রিকেট দলে ক্ষুদ্র শহরের প্রতিনিধিগণের দ্রুত উত্থান ও মহেন্দ্র সিংহ ধোনি প্রমুখের তুঙ্গস্পর্শী সাফল্য তাহাদের আত্মপ্রতিষ্ঠার সূচক হিসাবে প্রতিভাত। কলিকাতা ইহাদের প্রগতি-প্রয়াসের তুলনায় বহু ক্রোশ পিছাইয়া। তীব্র অপদার্থতা ও নিশ্চিত পরাজয়ের দূষিত বাতাস কলিকাতায় পরিব্যাপ্ত। এই শহরটিকে ভারতের অনান্য বৃহত্‌ শহরের অধিবাসিগণ ফাঁকিবাজি ও অবান্তর ঝামেলার শহর বলিয়া জানে। তাহারা মনে করে, এখানে যে সত্‌ ও উদ্যোগী হইয়া কাজ করিতে যায়, সে আলস্য, দুর্নীতি ও জটিল অজুহাতের প্রাচীরে মাথা ঠুকিয়া মরে। ফাঁপা বাক্যবিন্যাসে আত্মমুগ্ধ বাঙালি জাতির শহর বলিয়া, প্রচলিত রসিকতা অনুযায়ী এটি ‘ব্যানার্জি, চ্যাটার্জি, লেথার্জি ও অ্যালার্জি’-র শহর। একটি শহর আয়তনে বা ইতিহাসমূল্যে বড় হইলেই বড় হয় না, তাহাকে প্রতিনিয়ত যুগোপযোগী থাকিয়া, স্রোতে ভাসিবার পূর্বেই মোহানার ধারণা আয়ত্ত করিয়া, তাত্‌পর্যে ও গুরুত্বে বড় থাকিয়া যাইতে হয়। ‘অ্যালিস থ্রু দ্য লুকিং গ্লাস’-এ এক চরিত্র বলিয়াছিল, তুমি যেখানে আছো, সেখানেই থাকিতে চাহিলে, দৌড়াইয়া চলিতে হইবে। আগাইয়া যাইতে হইলে, দ্বিগুণ জোরে দৌড়াইতে হইবে। কলিকাতা এই দৌড় ছাড়িয়া দিয়া,আত্মতুষ্টির অলীক লবেঞ্চুস চুষিয়া, নিজ আভিজাত্যের কীটদষ্ট অ্যালবামখানি মহা যত্নে বহু দশক ধরিয়া উলটাইয়া চলিতেছে। সে সহজ বুদ্ধির বিরুদ্ধে যাইবে, বিনিয়োগ চাহিবে না, চিত্‌কৃত অতিনাটককে যুক্তি ও মানবদরদ হিসাবে চালাইবে, নুন আনিতে নিরন্তর পান্তা ফুরাইতেছে দেখিয়াও থালায় আলপনা রচিয়া সময় ও অর্থ বিলকুল খরচা করিয়া ফেলিবে। এক কালে মিছিলের নগরী বা মুমূর্ষু নগরী অভিধা শুনিয়া সে খেপিয়া লাল হইয়াছে, আজ নিজেকে ক্ষুদ্র শহরের গোত্রভুক্ত শুনিয়াও সে ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিবার প্রাণশক্তিটুকু সংগ্রহ করিতে পারিতেছে না। তাহার মূল কারণ, সে মজ্জায় মজ্জায় জানে, অপ্রিয় হইলেও, কথাটি সত্য। অন্য শহরগুলি একদা কলিকাতাকে বিস্ময় ও ঈর্ষার চক্ষে দেখিত, পরে বিদ্রুপ করিত, এখন এমনকী তাহা করিয়াও উহারা সময় নষ্ট করে না। কলিকাতা এখন কোনও কীর্তির, অবদানের, উত্‌সাহের আলোচনার পরিসরেও নাই। কলিকাতা নিজেও তাহার স্থবিরতা, অবসাদ সম্যক উপলব্ধি করে, মর্মে মর্মে মরিয়া থাকে, এবং সান্ধ্য বিতর্কের আসরে আত্মদংশন করিয়া হতাশা ও পরাজয়ের বদরক্ত মোক্ষণ করে। হয়তো এই তিক্ত স্ব-কশাঘাতের অভ্যাসে সে ক্ষুদ্র শহরের তুলনায় অনেক অগ্রসর এবং ইহাই তাহার নূতন জাঁক!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.