তারাবাজি
উল্টো ভাষা পাল্টা উচ্চারণ
মার বেশ কিছু ছোট ছোট ছাত্রছাত্রী আছে। তাদের বয়স তিন থেকে ষোলো। বেশির ভাগই ইংলিশ মিডিয়ম স্কুলে পড়ে। একটা ফুটফুটে পুতুলের মতো মেয়ে এসে দাঁড়াল। গোলাপি জামা, গোলাপি ক্লিপ, গাল দু’টোও গোলাপি। বছর তিন-চার বয়স, নার্সারিতে পড়ে। জিজ্ঞাসা করলাম, “নাম কী?” বলল, “লুবিয়া মুকার্জি।” ‘ক’টা একটু চেপে বলল। আমি বললাম, “কী, লুবিয়া মুখার্জি?” ও বলল, “না, লুবিয়া মুকার্জি।” এ বার ‘ক’টা আরও চেপে বলল। বুঝলাম, ওটাই শেখানো হয়েছে। এর পরে এল আর একটু বড় একটা মেয়ে। ক্লাস থ্রি। নাম বলল, প্রাচেতা বাসু। ‘প্র’টা ‘প্র’ আর ‘প্রা’য়ের মাঝামাঝি আ-য়ের দিকেই বেশি ঘেঁষা। আমি বললাম, “বাংলায় বলছ তো, বলো প্রচেতা বসু।” ও উল্টে আমাকে সংশোধন করল, “না, আমার নাম প্রাচেতা বাসু।” একটু পরে এল ক্লাস এইটের পৃথ্বী পুরকায়স্থ। ও-ও বলল, ওর নামের উচ্চারণ ‘পৃথ্থী’ নয়, পৃথ্বী। উচ্চারণগুলো সবারই হিন্দি ঘেঁষা। এরা কিন্তু কোনও বিক্ষিপ্ত উদাহরণ নয়। কান পাতলেই শুনবেন বাঙালি ছেলেমেয়েরা নাম বলছে ‘মীনাক্ষী’, ‘সাপ্নাজিৎ’, ‘আনিরুধ্’। নামের বানান যদিও লেখা অনিরুদ্ধ।
হয়তো ভাবছেন, এতে অসুবিধা কী? বানান অনুযায়ী মীনাক্ষী, পৃথবী এ সব উচ্চারণ তো হতেই পারে। আর অ-কে একটু আ-ঘেঁষা উচ্চারণ করলেই বা কী হয়? কিছুই হয় না বাংলা ভাষার নিজস্ব উচ্চারণটা নষ্ট হয়। ভাষাটা তো বাংলা হিন্দিও নয়, ইংরেজিও নয়। বাংলাটা বাংলার মতোই বলুন না! বাংলায় মীনাক্ষীর উচ্চারণ ‘মীনাক্খী’। ওটাই বাংলায় ঠিক উচ্চারণ। ভাবুন তো, কেউ জীবনানন্দ আবৃত্তি করছে, “হয়তো শুনিবে এক লাক্ষ্মী পেঁচা ডাকিতেছে শিমুলের ডালে”!
এই হিন্দি ঘেঁষা বা ইংরেজি ঘেঁষা বাংলাটা বিশেষ করে কলকাতার সমস্যা। জেলায় আবার অন্য সমস্যা একটা আঞ্চলিক টান কিংবা আঞ্চলিক অভ্যাস থাকে উচ্চারণে। মেদিনীপুরে যখন যাই, কত যে ‘Saধারণ’, ‘Soজা’ শুনতে পাই। মেদিনীপুরের আঞ্চলিক উচ্চারণে S-এর ব্যবহার একটু বেশি। সেটা অবশ্য চেষ্টাকৃত নয়। সুকেশ জানার নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন বিখ্যাত এস্রাজ বাদক। ওঁর বাড়ি মেদিনীপুর। একটা স্মৃতিকথায় একটা মজার গল্প শুনিয়েছিলেন তিনি। তিনি তখন সঙ্গীতভবনে ভর্তি হয়েছেন। নবীনবরণ উৎসবে গাইলেন, “আমার নয়ন-ভুলানো এলে।” মেদিনীপুরের স্থানিক উচ্চারণ নিয়ে তিনি গানটা গাইলেন, “সিউলিতলার পাসে পাসে/ ঝরাফুলের রাসে রাসে/ সিসিরভেজা ঘাসে ঘাসে...”। এর পর খাবার ঘরের দেওয়ালে একটা ছবি আঁকা হল। একটা ছেলে ধুতি ও শার্ট পরা, গদার মতো করে তানপুরা কাঁধে নিয়ে ঘাসের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। তলায় লেখা, ‘সিসির ভেজা ঘাসে ঘাসে’। এই ঘটনাটি লিখে লেখক জানিয়েছিলেন মোহরদি কত যত্ন নিয়ে তাঁর এই উচ্চারণ ঠিক করে দিয়েছিলেন।
‘স’য়ের গোলমাল এটাই একমাত্র নয়। ‘সিউলিতলায়’ যেমন কেউ কেউ হাঁটেন, তেমনই অনেকে ‘শাইকেলে’ চড়ে ‘শিনেমা’ দেখতে যান। আবার বেশ পরিশীলিত উচ্চারণ, আপাতভাবে স-শ-য়ের কোনও গোলমাল নেই সে রকম মানুষও ‘আস্তে আস্তে দেখেন’। না, ধীরে ধীরে দেখেন না অনেকেরই ‘আসতে আসতে দেখলাম’টা হয়ে যায় ‘আস্তে আস্তে দেখলাম’। অনেককেই গাইতে শুনেছি, “সূর্য ডোবার পালা আসে যদি আসুক, বেস্ত।”
উচ্চারণের আর একটা স্থানিক সমস্যা মনে পড়ল চন্দ্রবিন্দু। ওপার বাংলা যাঁদের আদি বাড়ি, তাঁরা কিছুতেই চন্দ্রবিন্দু লাগান না। এ নিয়ে একটা ভাল গল্প আছে চন্দ্রবাবুর গল্প। চন্দ্রবাবু তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গ চন্দ্রবিন্দুদের নিয়ে নৌকাবিহারে বেরিয়েছেন পদ্মা নদীতে। হঠাৎ ঝড় উঠল। নৌকা গেল ডুবে। চন্দ্রবাবু তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে কোনও মতে সাঁতরে এসে উঠলেন এ পারে। তার পর থেকে এ পারে শ’য়ে শ’য়ে চন্দ্রবিন্দু, আর ও পারে চন্দ্রবিন্দু নেই। পদ্মার এ পারের মানুষেরা তাই ‘হাঁসেন’, ‘হাঁসপাতালে’ যান আর ও পারের মানুষেরা ‘কাদেন’, ‘রাধেন’, ‘বাধেন’। তবে কী জানেন, এ সব ভুল খুব একটা গুরুতর নয়। এগুলো একটু চেষ্টা করলেই শুধরে নেওয়া যায়। ছোটদের তো একটু যত্ন নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।
কলকাতার ছোটরা কিন্তু আমাকে ভাবায়। আমি জানি না, কতটুকু বাংলা পড়ে ওরা। অনেককেই দেখি বাংলা কবিতা ইংরেজি হরফে লিখে নিয়ে যায়। একটা ভাষা ভাল করে না পড়লে কি তার প্রতি ভালোবাসা আসে? ভালোবাসা না এলে কি শুদ্ধতা আসে? উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর দেড়শো বছর হয়ে গেল। ক’জন পড়েছে টুনটুনির বই? কিংবা সুকুমার রায় হ য ব র ল? কিংবা লীলা মজুমদারের হাতির গল্প? হলদে পাখির পালক? বই পড়ার কথা এই জন্য বলছি যে, বই পড়তে পড়তে শব্দভাণ্ডার বাড়ে, শব্দ নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়। ঠিক উচ্চারণটাও জানার ইচ্ছে হয়।
হ য ব র ল প্রসঙ্গে হিজিবিজবিজের কথা মনে পড়ল? সে এক জনের কথা বলেছিল, যে সব জিনিসের নাম দিত। তার জুতোর নাম অবিমৃশ্যকারিতা, ছাতার নাম প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, গাড়ুর নাম পরমকল্যাণবরেষু, বাড়ির নাম কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এখনকার ছোটরা কি এ সব পড়ে? পড়তে পারবে? উচ্চারণ তো দূরের কথা, শব্দগুলো দেখেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যাবে না তো?
অলঙ্করণ: সুমন চৌধুরী
আমরা তো ছোট থেকে বাংলাতেই কথা বলতে শিখি। ইংরেজিটা অভ্যাস করতে হয়। বাংলাটা তাই আমার মনে হয় হাঁটাচলার মতো সহজ। ইংরেজিটা সাইকেল চড়ার মতো। কিন্তু হাঁটাচলার মতো সহজ জিনিসটা যে কেন আমরা সহজে করতে পারছি না, কে জানে! হিন্দি বা ইংরেজির মতো করে বাংলা বললে কি একটু বেশি স্মার্ট হওয়া যায়?
মজার ব্যাপার হল, ইংরেজি বা হিন্দি জানার সঙ্গে বাংলা না-জানার কোনও সম্পর্ক নেই। লীলা মজুমদার তো সাহেবি স্কুলেই পড়েছিলেন একেবারে ছোটতে শিলংয়ের লোরেটোয়। তার পর এগারো বছর বয়েসে ডায়াসেশন। তাঁকে কি বাংলা ভুলতে হয়েছে? তিনি কি ইংরেজির টানে বাংলা বলেন, নাকি বাংলা লিখতে গিয়ে অর্ধেক কথা ইংরেজিতে লেখেন? আর সত্যজিৎ রায়? তিনি তো পড়েছিলেন বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলে। কিন্তু চমৎকার ইংরেজি বলতেন। তার জন্য তো বাংলাকে ইংরেজি করে ফেলতে হয়নি। বাংলাই হোক বা ইংরেজি একটা ভাষা শুদ্ধভাবে শুদ্ধ উচ্চারণে বলাটাই স্মার্টনেস।
রসায়নের এক অধ্যাপকের কাছে গল্প শুনেছিলাম, তাঁর এক ছাত্রী প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে তাঁকে বলেছিল, “আমার সলিউশন বনে গেছে।” আসলে বলতে চেয়েছিল, “আমার সলিউশন হয়ে গেছে।” সে অধ্যাপকও তেমনি। বাংলায় তুখোড়। বললেন, “তবে আর কী, একটা গাড়ি ভেজে ফ্যালো। নিয়ে আসবে।” ছাত্রীটি একটু ঘাবড়ে গিয়ে চুপ করে রইল। তারপর বলল, “আমার বাংলাটা একটু খারাপ।” এটা নাকি ‘একটু খারাপ’! যাই হোক, বাঙালি হয়ে ‘আমার বাংলা খারাপ’ বলার মধ্যে কোনও কৃতিত্ব দেখি না।
এফএম যখন শুনি, বাঁকানো বাংলা উচ্চারণ বড় কানে লাগে। তার মধ্যে আবার গুচ্ছের ইংরেজি শব্দ। একটা নমুনা শুনুন। “তাহলে লেটস্ লিসন টু আ সং। আমরা ব্যাক করে যাই আ কাপল অব ডিকেডস। শুনে নিই ফিফটি ইয়ারস্ আগের একটা ওয়ান্ডারফুল ক্রিয়েশন!” এটা কি বাংলা? নাকি বলবেন, ওরা নতুন ভাষা সৃষ্টি করছে? আমি কিন্তু অত আশাবাদী হতে পারলাম না!
রাজশেখর বসুর একটা গল্প দিয়ে লেখা শেষ করি। ‘উলট্ পুরাণ’। এই গল্পে ভারতবর্ষ ইংল্যান্ড সহ ইউরোপ দখল করেছে। স্বাধীনতা আন্দোলন করছে ইংরেজরা। আবার কিছু চাটুকার ইংরেজ পরিবার অবশ্য অন্ধভাবে ভারতীয় সংস্কৃতির অনুকরণে ব্যস্ত। এমনই এক পরিবারের গৃহশিক্ষক জোছনাদি। জোছনাদি সেই পরিবারের বড় মেয়ে ফ্লফিকে এক-দুই-তিন শেখাচ্ছিলেন। ফ্লফি ‘চার’কে প্রথমে বলল ‘শাড়’। তার পর সংশোধন করে দেওয়াতে ঠিক বলল। কিন্তু ‘পাঁচ’টা কিছুতেই ‘পাঁচ’ বলতে পারল না। প্রথমে বলল ‘পাঁইচ’, তার পর বলল ‘পাঁইশ’। শেষে মরিয়া হয়ে বলল ‘ফ্যাঁচ’। আজকাল মাঝে মাঝেএই গল্পটা মনে পড়ে। আমরাও কিও দিকেই এগোচ্ছি? তফাত অবশ্য একটা আছে। ফ্লফি ঠিক উচ্চারণটা করতে পারেনি, আর আমরা না-পারার জন্য চেষ্টা করছি।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.