বণিকসভার মঞ্চে দাঁড়িয়ে সংস্কারের পক্ষে সওয়াল করলেন ভারতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ন্যান্সি পাওয়েল। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই সওয়ালের পক্ষে যে-যুক্তি তিনি খাড়া করলেন, তার প্রতিটি পরতই পরোক্ষে রাজ্যের আর্থিক নীতির সমালোচনাই।
মঙ্গলবার বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্সের অনুষ্ঠানে বিনিয়োগের উপর উন্নয়নের নির্ভরশীলতাই ছিল তাঁর বক্তব্যের মূল প্রতিপাদ্য। এই প্রসঙ্গেই সংস্কারের পক্ষে যে-সওয়াল তিনি করেন, সেই যুক্তির বাণে প্রত্যক্ষ ভাবে উঠে আসে সামগ্রিক সংস্কার প্রসঙ্গই। আর তাতে তিনি কাঠগড়ায় দাঁড় করান ভারতের আর্থিক ‘অনুদার’ নীতিও। সংস্কারের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের দায়বদ্ধতার প্রশংসা করলেও তিনি জানিয়ে দেন সংস্কারের পথে এখনও অনেকটাই হাঁটা বাকি রয়েছে।
তিনি বলেন, সংস্কারের পথেই আসবে ভারতের আর্থিক বৃদ্ধি। সেই সংস্কারের জন্য অনুকূল পরিবেশ গড়ে তুলতে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনার পথ তৈরি করবে শিল্পমহল। সরাসরি খুচরো ব্যবসার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেননি তিনি। কিন্তু খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের বিরোধী রাজ্য সরকারের শহরে এসে প্রায় কুড়ি মিনিটের ভাষণে একাধিকবার বিদেশি বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন তিনি।
এ রাজ্যেও বিদেশি বিনিয়োগ কি ভাবে কাজে এসেছে, তার উদাহরণ তুলে ধরেন পাওয়েল। তাঁর দাবি, আমেরিকার উদারনীতির কারণেই হাওড়ার ফাউন্ড্রি শিল্প সেখানে বাজার তৈরি করতে পেরেছে। একই ভাবে পেপসিকোর নাম না-করেও তিনি কৃষিতে বিদেশি বিনিয়োগের ইতিবাচক প্রভাবের প্রসঙ্গ তোলেন। তিনি বলেন, “পশ্চিমবঙ্গের কয়েক হাজার আলু চাষি বিদেশি বিনিয়োগের ফলে তাঁদের রোজগার বাড়িয়েছেন।” এই উদাহরণ রাজ্যের কৃষি বিপণন ও খুচরো ব্যবসা সংক্রান্ত অবস্থানের বিপক্ষেই।
তবে শুধুই রাজ্য নয়। কেন্দ্রের ভূমিকা নিয়ে সরাসরি সোচ্চার হয়েছেন পাওয়েল। সংস্কারের প্রতি কেন্দ্রের দায়বদ্ধতার প্রশংসা করলেও তাঁর দাবি, এখনও অনেক কিছু করতে হবে। বৃদ্ধির হার ১০ শতাংশে নিয়ে যেতে সংস্কারের পথে আরও কিছু পদক্ষেপ জরুরি বলে তাঁর মত।
পাওয়েলের মনে করেন ভারতের অর্থনীতি এখনও উদার নয়। বিদেশি লগ্নি সম্পর্কেও বিরূপ ধারণা রয়েছে দেশের নীতিকারদের। মান্ধাতার আমলের এই ধারণা পিছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার সময় হয়েছে বলে মনে করেন পাওয়েল। তিনি বলেন, “গত দু’দশকে ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির কারণ বিদেশি লগ্নি।” তিনি এও জানান, শুধুই আর্থিক বৃদ্ধি নয়। জীবনযাপনের মানোন্নয়ন ও দারিদ্র দূর করতে বিদেশি লগ্নি জরুরি। তিনি আরও বলেন, লগ্নির অভাবে ধুঁকছে ভারতের পরিকাঠামো শিল্প। বিদেশি লগ্নি এই সমস্যা দূর করতে পারবে। এ দিন তিনি বিমা ও ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রেও সংস্কারের প্রসঙ্গ তোলেন। পাওয়েলের দাবি, উদার নীতির হাত ধরে তৈরি হয় বাজার। আর নতুন বাজার তৈরি করে কর্মসংস্থান। শিল্পমহলের অনুষ্ঠানে পাওয়েলের কথায় উদারনীতির সঙ্গে উঠে এসেছে ছোট ও মাঝারি শহরের ভূমিকাও। পাওয়েল দিল্লি, মুম্বইয়ের পাশাপাশি ছোট ও মাঝারি শহরের বৃদ্ধির প্রসঙ্গ তোলেন। উপস্থিত শিল্পমহলের উদ্দেশে তিনি বলেন, “জাতীয় নীতি তৈরি করার ক্ষেত্রে শিলিগুড়ি, আসানসোল, মালদহ ও মুর্শিদাবাদের মতো শহরের গুরুত্ব বাড়ছে। এদের নিয়ে আলোচনা উচিত।
কলকাতা নয়। ব্যবসা ও জাতীয় অর্থনীতির কথা উঠলে প্রথমেই মনে পড়ে বেঙ্গালুরু, মুম্বই, তামিলনাড়ু ও দিল্লির নাম। ভারতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে তৃতীয় বার কলকাতায় এসে পাওয়েলের দাবি, তাঁর তালিকায় কলকাতাও রয়েছে। এবং শুধু কলকাতা নয়। দুর্গাপুর, শিলিগুড়ি, রায়পুর, রাঁচি ও পটনার মতো শহরের দিকে নজর দেওয়ার কথা বলেন তিনি। কারণ তাঁর মতে দেশের আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক দিশা তৈরি করার ক্ষেত্রে এদের ভূমিকা বড়। |