কানের পাশ থেকে ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে। গায়ে-হাতে অজস্র আঘাতের চিহ্ন। তবু দু’হাতে জাপটে রেখেছেন ছোট্ট মেয়েটাকে। ধ্বংসস্তূপ থেকে সদ্য খুঁজে পেয়েছেন নিজের ছাত্রীকে। মায়ের কাছে পৌঁছে দিতে হবে তো!
টর্নেডো-বিধ্বস্ত ওকলাহোমার মুরে আজ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে দু’-দু’টো স্কুল। এখনও পর্যন্ত ২০টি শিশুর মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। খোঁজ মিলছে না আরও অনেকের। এদের অধিকাংশই তখন স্কুলে ছিল। ঝড়ের সময় এমনকী স্কুলের সুইমিং পুলেও ছিল কিছু পড়ুয়া। ঝড় থামার পর পুল থেকে উদ্ধার করা হল সাত জনের নিথর দেহ। ঝড়ের তাণ্ডব থামতে না থামতেই প্লাজা টাওয়ার এবং ব্রায়ারউড স্কুলের বাইরে দেখা গেল বাবা-মায়েদের হাহাকার। স্কুল দেখে স্কুল বলে তখন চেনার উপায় নেই। ইট-কাঠ-পাথরেরএকটা ভগ্নস্তূপ কেবল।
একে একে ছেলেমেয়েদের কোলে করে বার করে আনছেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা। এক শিক্ষিকাকে দেখা গেল, তাঁর খুদে ছা্ত্রীর হাত ধরে বেরিয়ে আসছেন। বাঁ চোখ প্রায় বন্ধ, নাক থেকে রক্ত বেরিয়ে গলা-বুক ভেসে যাচ্ছে। আর মেয়েটি, বাবা-মাকে দেখতে না পেয়ে কেঁদেই চলেছে অঝোরে। |
কান্নাকাটি-চিৎকার-আর্তনাদে তখন উদ্ধারকাজ মাথায় ওঠার অবস্থা। কে কোথায় আছে, তা জানাতে ভগ্নস্তূপের তলা থেকে ছোটরা আপ্রাণ চেঁচিয়ে যাচ্ছে। এ দিকে বাইরের চিৎকারে সেই আওয়াজ শোনাই দায়। পরিস্থিতি সামলাতে কিছু ক্ষণ পরেই বাবা-মায়েদের পাঠিয়ে দেওয়া হল সামনের ওকলাহোমা গির্জায়। উদ্ধার-কর্মীরা যাতে তাদের আওয়াজ ঠিক মতো শুনতে পায়, তাই এই ব্যবস্থা। সেখানকার ছবিটাও ক্রমেই করুণ হয়ে উঠল।
চোঙা হাতে একে একে পড়ুয়াদের নাম ডাকা হচ্ছে। সন্তানকে দেখতে পেয়ে কখনও বাবা-মায়েরাই ছুটে যাচ্ছেন। জাপটে ধরছেন দু’হাতে। কখনও আবার ছোট্ট হাতে মাকে জড়িয়ে হাপুস নয়নে কেঁদে চলেছে খুদে। সেই দৈত্যাকার ঘূর্ণির ফণাটা ভুলতে পারছে না তার শিশুমন। আবার একা একাই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল কয়েক জন পড়ুয়াকে। তাদের নিতে কেউ আসেনি। উদ্ধারকর্মীরা তাদের হাত তুলে নাম ধরে অনেক ডাকলেন, তবু কেউ এগিয়ে এল না।
গির্জায় একটা টেবিলের উপর বসে ছিলেন টনিয়া শার্প এবং ডিয়েনা ওয়ালেস। লাইন করে ছোটদের একটা দলকে নিয়ে ঢুকলেন শিক্ষিকা। মেয়েকে দেখতে পেয়েই টেবিল থেকে লাফিয়ে উঠলেন ডিয়েনা। মাকে দেখে লাইন ভেঙে ছুটে এল বছর ষোলোর কিশোরী। জড়িয়ে ধরল দু’জনে দু’জনকে।
গির্জার এক দিকে যখন মিলন-দৃশ্য, অন্য পাশে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে বাবা-মায়েদের একটি দল। তাঁদের সন্তানের নাম ধরে কেউ ডাকছে না। কেউ বলছে না তারা কোথায়। মনে মনেই আতঙ্কের বীজ বুনছেন বাবা-মায়েরা। টনিয়া বললেন, “আমার মেয়েটার মৃগী আছে। কোথায় আটকে রয়েছে কে জানে? ওষুধ তো খাওয়া হয়নি।” টনিয়া এগিয়ে গেলেন উদ্ধারকর্মীদের দিকে। নিখোঁজের তালিকায় মেয়ের নাম লেখাতে হবে। তখনও যিশুর কাছে প্রার্থনা করে যাচ্ছেন বাকিরা।
সু ওগরোকি, পেশায় আলোকচিত্রী। নেশায় ঝড়-শিকারী। গত এক দশকে ডজনখানেক টর্নেডোর ছবি তুলেছেন তিনি। এ বারও খবর পেতেই অফিস থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন। যখন মুরে পৌঁছলেন, ঝড়ের তাণ্ডব শেষ। স্থানীয় এক মহিলা চিনিয়ে দিলেন, এখানেই প্লাজা টাওয়ার স্কুলটা ছিল। সু বললেন, “পুরনো অভিজ্ঞতা থেকেই ভেবেছিলাম নিশ্চয়ই খুব বিশৃঙ্খল অবস্থা হবে। কাছে গিয়ে দেখলাম, অসম্ভব শান্ত। বড় একটা দেওয়ালের তলায় চাপা পড়ে রয়েছে ছোটরা। পুলিশ তাদের বার করার চেষ্টা করছে।” তুলনায় অ্যাগেপল্যান্ড লার্নিং সেন্টারের ছবিটা অনেক ভাল। মূলত শিশুদের দেখাশোনা করা হয় সেখানে। উদ্ধারকর্মীরা যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছলেন, সেন্টারটা ভেঙেচুরে শেষ। আংশিক ভাবে দাঁড়িয়ে আছে শুধু একটা শৌচাগারের কাঠামো। সেখান থেকেই ক্ষীণ স্বরে ভেসে আসছে খুদে কণ্ঠের গান, “ইউ আর মাই সানশাইন...।” সেন্টারের কর্তৃপক্ষ জানালেন, ২টো বেজে ৪০ মিনিট নাগাদ টর্নেডোর সতর্কবার্তা এসেছিল তাঁদের কাছে। গায়ে ভাল করে চাদর জড়িয়ে সেন্টারের ১৫ জন শিশুকে তারা ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন বাথরুমে। বলেছিলেন, “তোমরা সবাই মিলে গান গাও, কিচ্ছু হবে না।” টর্নেডো উড়িয়ে নিয়ে যায় বাথরুমের ছাদ। কিন্তু বাকি কাঠামোটা টিকে যায়। দিনের শেষে তাই খুশির আবহ অ্যাগেপল্যান্ডে। ডিরেক্টর ক্যাথি উইলসন গর্বের সঙ্গে বললেন, “আমাদের একটি শিশুর গায়েও তেমন কোনও আঘাত লাগেনি।” |