এই নিয়ে তিন বার হল। গুল্টুর মারা বল এসে লাগল নীরজ শর্মার জানলায়। ঝনঝন শব্দে ভেঙে পড়ল কাচ।
আগের দু’বার অবশ্য কাচ ভাঙেনি। প্রথম বার বল সেন্টার টেবিলে রাখা ফুলদানিটা উল্টে দিয়েছিল, পরের বার এসে লেগেছিল দেওয়ালে টাঙানো একটা
অয়েল-পেন্টিংয়ে।
গুল্টুর ভাল নাম পল্লব। পড়ে বিদ্যানিকেতনের ক্লাস সিক্সে। ভাল ব্যাটসম্যান বলে পাড়ায় নাম আছে। গুল্টুর বাবা রণজয় বসুর সঙ্গে তাদের উল্টো দিকের ফ্ল্যাটের নীরজ শর্মার সম্পর্ক এখন যাকে বলে আদায় কাঁচকলায়। রণজয় এই ‘মধুবন হাউজিং’ কমপ্লেক্সের সেক্রেটারি। এখানকার বারোটি পরিবারের নিরাপত্তা ও সুখ, সুবিধে দেখার দায়িত্ব তাঁর ওপর। সে কাজ করতে গিয়ে শর্মা সাহেবের সঙ্গে তাঁর কথা কাটাকাটি হওয়ার পর এখন দু’জনের মুখ দেখাদেখি বন্ধ।
বছর চল্লিশ বয়সের ছিপছিপে লম্বা নীরজ শর্মাকে অনেকটা হলিউড তারকা গ্রেগরি পেকের মতো দেখতে। একটি বিজ্ঞাপন সংস্থার আর্ট ডিরেক্টর তিনি। থাকেন নম্বর টু-বি অর্থাৎ লনের সামনের দোতলার ফ্ল্যাটে। ফুলহাতা শার্ট, ওপরে জ্যাকেট আর ট্রাউজার্স এই তাঁর সারা বছরের পোশাক। নিজেই একটা টু-সিটার গাড়ি চালিয়ে অফিসে যান এবং ফেরেন।
শর্মা সাহেবের এই কাজে বেরনো এবং ফেরার সময়ের কোনও ঠিক নেই। প্রায়ই তিনি বের হন দিনের আলো ফোটার আগে, ফেরেন মাঝরাতে। এতেই রণজয় বসুর আপত্তি। তিনি একাধিক বার নীরজ শর্মাকে ডেকে বলেছেন, ‘দেখুন, আপনার কাজে বেরনো এবং ফেরার সময়টা ঠিক করুন। আপনার জন্যে হাউজিংয়ের সিকিউরিটির লোকদের খুব অসুবিধে হচ্ছে।’ |
‘আমি দুঃখিত’, শর্মা বলেছিলেন, ‘এটা আমার পক্ষে করা শক্ত, আমার কাজের ধরনটা এমন যে সেটা দশটা-পাঁচটার রুটিনে বাঁধা যায় না। আমাকে বিজ্ঞাপনের ফিল্ম শুট করতে হয়। মাঝে মাঝে মুম্বই থেকে আর্টিস্ট আনতে হয় এ জন্যে। শুটিং হয় কখনও বেড়াচাঁপা, কখনও ধপধপি, কখনও জাতীয় সড়কে রাস্তাঘাট নির্জন হয়ে যাওয়ার পর। আর্টিস্ট ছাড়া আরও বহু লোক লাগে ছবি তুলতে। বুঝতেই পারছেন কাজ নির্দিষ্ট সময় শুরু এবং শেষ করাটা আমার হাতে থাকে না।’
এ কথায় চিঁড়ে ভেজেনি। রণজয় বলেছিলেন, ‘সোসাইটি আপনার যুক্তি মানতে রাজি নয়। আমরা যে এজেন্সিকে নিরাপত্তার দায়িত্ব দিয়েছি তারা খুব সকালে এবং বেশি রাতে গেট খোলা এবং বন্ধ করা নিয়ে আপত্তি করেছে। রাত বারোটার সময় গেট খোলা মানেই বিপদ ডেকে আনা। গত সপ্তাহে এ নিয়ে ম্যানেজিং কমিটির মিটিং হয়েছে। মেম্বাররা আপনাকে সতর্ক করে দিয়েছেন।’ ‘আমি অপারগ’, শর্মা দু’হাত সামনে মেলে বলেছিলেন, ‘আমার কাজের ধরনটা যে আর পাঁচ জনের মতো নয়, সেটা বুঝতে হবে কমিটিকে।’ ‘আপনি দেখুন না চেষ্টা করে’, রণজয় বলেছিলেন, ‘অন্য কোথাও চাকরি পেতে পারেন কি না।’ ‘পাগল নাকি’! নীরজ হেসেছিলেন, ‘আমার বিয়াল্লিশ বছর বয়স, এই বয়সে কে আমায় চাকরি দেবে! তা ছাড়া আমি এ কাজটা করে খুব আনন্দ পাই।’ ‘ঠিক আছে’, রণজয় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান, ‘আমি তা হলে আপনাকে একটা নোটিস পাঠাচ্ছি। আপনি যা বলার লিখে জানাবেন। কমিটি ঠিক করবে তারা কী করবে।’
পর দিনই রণজয় বসুর সই করা চিঠি পেলেন শর্মা। তাতে বলা হয়েছে, আগে অনুমতি না নেওয়া থাকলে কোনও সদস্যের জন্যে মেন গেট সকাল ছ’টার আগে এবং রাত দশটার পর খোলা হবে না। এক জন সদস্য প্রায়ই এই নিয়ম ভাঙেন, তাই তাঁকে বিশেষ ভাবে সতর্ক করে দেওয়া হচ্ছে। নির্দেশ না মেনে
চললে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।
রাতে সে নোটিস পেয়ে পর দিন সকালে শর্মা রণজয় বসুর ফ্ল্যাটে হাজির হন। নোটিসটা দেখিয়ে বলেন, ‘এটা কী, মিস্টার বাসু? কী ভাষায় চিঠি লিখেছেন আপনি আমায়! আমি তো বাইরের কেউ নই, আপনাদেরই মতো এক জন ফ্ল্যাটের মালিক। সেটা মনে রাখার প্রয়োজন মনে করেননি!’
মাথা নেড়ে রণজয় বলেন, ‘আমি নিরুপায় মিস্টার শর্মা, চিঠির সইটা আমার, কিন্তু ভাষা ম্যানেজিং কমিটির, তাঁদের মধ্যে এক জন উকিল, এক জন চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট। আচ্ছা, নমস্কার।’
যতক্ষণ দু’জন সমবয়সী মানুষের মধ্যে এই সব কথা হচ্ছিল ততক্ষণ গুল্টু তার বাবার পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিল বড়দের মধ্যে ঝগড়া হলে তাদের রাগ রাগ মুখ কেমন দেখায়। সেই দিন থেকে বসু আর শর্মার মধ্যে অশান্তি, কেউ কারও সঙ্গে কথা বলেন না, এক জন আর এক জনকে দেখলে মুখ ফিরিয়ে নেয়। অথচ দু’জনেই এক কলেজ, স্কটিশের ছাত্র। এক জন পঁচাশি সালের গ্র্যাজুয়েট,
এক জন ছিয়াশির।
সেই রণজয় বসুর ছেলে গুল্টু মানে পল্লবের মারা বলে আজ নীরজ শর্মার জানলার কাচ ভেঙেছে। এই নিয়ে তিন বার। আগের দু’বার অবশ্য কাচ ভাঙেনি। প্রথম বার বল ঘরের মধ্যে একটা সেন্টার টেবিলে লাগতে একটা ফুলদানি উল্টে যায়, দ্বিতীয় বার বল এসে লাগে দেওয়ালে টাঙানো একটা অয়েল পেন্টিংয়ে। শর্মা সে দিন ঘরে তাঁর ক্যামেরাম্যান চিত্রভাণুর সঙ্গে কথা বলছিলেন। বল হাতে নিয়ে বারান্দায় বেরিয়ে তিনি প্রশ্ন করেন, ‘কে মেরেছে বল?’
গুল্টু সামনেই ছিল, জবাব দেয়, ‘আমি।’
বলটা ছুড়ে দিয়ে নীরজ বলেন, ‘এ বার ছেড়ে দিলাম। পরের বার বল আমার ঘরে ঢুকলে কিন্তু শাস্তি পেতে হবে।’
তিন বারের বার যে বল লাগল সেটা ছিল একটা ছুটির দিন
গুড ফ্রাইডে। ঝনঝন শব্দে কাচ ভেঙে পড়তে শর্মা বল হাতে বারান্দায় বেরিয়ে জানতে চাইলেন, ‘কে মেরেছে বল?’ গুল্টু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। তার হাতে ক্রিকেট ব্যাট।
বুঝেছি, শর্মা বলেন, ‘আমি আসছি।’ শর্মা নীচে নেমে এলেন। তাঁর পরনে ফুলহাতা শার্ট, ট্রাউজার্স। ঠিক যেন ‘রোমান হলিডে’র হিরো। হাতে বল নিয়ে ঠিক যেখানে দাঁড়িয়ে বোলার বল করে সেখানে দাঁড়িয়ে গুল্টুকে বলেন, ‘আমি বল করব, তোমায় ব্যাট করতে হবে। এই তোমার শাস্তি।’
গুল্টু ব্যাট নিয়ে দাঁড়াল। শর্মা বল করলেন। চমৎকার গুড লেংথ বল, গুল্টু বেশ এগিয়ে সপাটে মারল অনেকটা বেহালার ‘দাদা’র ভঙ্গিতে। বল আকাশে উড়ল, শূন্যে লাফিয়ে উঠে এক হাতে ক্যাচ ধরলেন শর্মা। ছেলেরা আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল। বল বোলারকে ফেরত দিয়ে গুল্টুকে শূন্যে ছুড়ে দু’হাতে লুফে নিয়ে হাসতে হাসতে শর্মা বললেন, ‘এই তোমার শাস্তি।’
নিজের ফ্ল্যাটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রণজয় বসু এ দৃশ্য দেখলেন। পাশে তাঁর মা দাঁড়িয়ে, তিনি দেখলেন ছেলে সবুজ লনের দিকে তাকিয়ে তার চোখে পলক পড়ছে না। মাঝে শনিবার বাদ দিয়ে রবিবার সকালে রণজয় শর্মার ফ্ল্যাট এসে বললেন, ‘আমি নোটিসটা ফেরত নিতে এসেছি নীরজ। কমিটি দুঃখিত আপনাকে ও রকম ভাষায় চিঠি লেখার জন্যে।’
যে হাতে বল দিয়ে গুল্টুকে আউট করেছিলেন শর্মা সেই হাতে ফেরত দেন ম্যানেজিং কমিটির নোটিস। সেটা পকেটে পুরে খপ করে শর্মার হাতটা ধরে ফেলেন রণজয়। ঝাঁকুনি দিয়ে বলেন, ‘পুরনো দিনগুলো কত ভাল ছিল তাই না, নীরজ?’ হেসে শর্মা বলেন, ‘হ্যাঁ, অনেকটা আজকের সকালের মতো...।’ আর একটা কথা না বলে পারছি না রণজয় বলেন, ‘তোমার বোলিংয়ের ধার একটুও কমেনি। আর ওই ভাবে ক্যাচ লোফা...’
শর্মা সামনে একটু ঝুঁকে তাঁর এক বছরের সিনিয়র পোড়োকে অভিবাদন জানান। জবাবে বসু তাঁর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেন, ‘ভাল থেকো।’
গুল্টুর বন্ধুরা সেখানে কেউ ছিল না, থাকলে হইহই করে হাততালি দিয়ে উঠত মনে হয়।
আর গুল্টু দু’হাত শূন্যে তুলে চেঁচিয়ে উঠত, ‘হুর রে!’ |