বিশ বাঁও জলে আগেই পড়েছিল সে। এ বার রেল মন্ত্রকের কাছে কার্যত ‘ক্যানসার রোগী’ হয়ে দাঁড়িয়েছে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো। এর ভবিষ্যৎ যে প্রায় অন্ধকার, তা ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিচ্ছেন রেলের শীর্ষ কর্তারাই। রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরীর বক্তব্য, “এই ক্যানসার রোগীকে কী থেরাপি দেওয়া হবে, সেটাই এখন ভাবা হচ্ছে।” রেল দফতর সূত্রের খবর, প্রায় চার হাজার ৯০০ কোটি টাকার এই প্রকল্পে গত পাঁচ বছরে কাজ হয়েছে মাত্র ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। তার জন্য খরচ হয়েছে প্রায় হাজার কোটি টাকা।
কেন এই অবস্থা?
রেলের কর্তারাই বলছেন, এক দিকে টাকার অভাব এবং অন্য দিকে জমি-জট। তার সঙ্গে রয়েছে প্রশাসনিক ডামাডোল। প্রাক্তন রেল-কর্তা সুভাষরঞ্জন ঠাকুরের কথায়, “অবিলম্বে পুরো কাজটা রেলের ইঞ্জিনিয়ারদের দিয়ে করানো উচিত। পাশাপাশি ‘কেএমআরসি’ প্রশাসনকেও শক্ত করে তৈরি করা প্রয়োজন। না-হলে কাজ এগোবে না।” রেল-কর্তাদের একাংশের অভিযোগ, যাঁরা এখন ওই প্রকল্পের কাজ দেখছেন, তাঁদের বেশির ভাগেরই রেলের কাজে কোনও অভিজ্ঞতা নেই। ফল যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। কাজ কিছুই হচ্ছে না।
রেল সূত্রে খবর, ইতিমধ্যেই তিন বার ওই প্রকল্পটি হাতবদল হয়েছে রাজ্য সরকার, কেন্দ্রীয় সরকারের নগরোন্নয়ন মন্ত্রক ও রেল দফতরের মধ্যে। তাতেই কাজের গতি থমকে গিয়েছে। তার পরে রয়েছে টাকার সমস্যাও। যে বিদেশি সংস্থা প্রকল্পের কাজের জন্য বিনিয়োগ করবে বলেছিল, তারাও এখন পিছিয়ে গিয়েছে। ফলে অবস্থা ক্রমশ জটিল হয়েছে। বর্তমানে প্রকল্পটি রেলের হাতে। কিন্তু রেলের এখন আর্থিক অবস্থা নড়বড়ে থাকায় তারাও খরচের এই বিরাট বোঝা নিতে পারছে না। আর তাতেই বেড়ে গিয়েছে সমস্যা।
রেল-কর্তাদের একাংশের অভিযোগ, এখন টাকাও যদি বরাদ্দ করা হয়, তা হলেও প্রকল্পের কাজে অগ্রগতি হওয়া খুব দুষ্কর।
রেল-কর্তারা জানান, প্রথম থেকেই এই প্রকল্পের কাজের প্রক্রিয়া খুব জটিল করে দেওয়া হয়েছে। আর তাতেই বেড়েছে গোলমাল। ধরা যাক, কোনও ঠিকাদার সংস্থা নকশা তৈরি করবে। তাকে তা দেখাতে হবে উপদেষ্টা সংস্থাকে। তা অনুমোদন করলে সেটি আসবে কেএমআরসি-র কাছে। কেএমআরসি অনুমোদন করলে তখন কাজ হবে। কিন্তু মূল ঠিকাদার হয়তো চেন্নাইয়ের। তিনি কলকাতার আর এক সংস্থাকে দিয়ে কাজ করাচ্ছেন। আর উপদেষ্টা সংস্থা হল বিদেশি। ফলে ফাইল ঘুরে আসতে গিয়েই লেগে যাচ্ছে কম করে তিন-চার মাস।
আর রেল-কর্তাদের আপত্তি এটা নিয়েই। তাঁদের বক্তব্য, প্রথমত এত সময় অযথা নষ্ট হচ্ছে। তার পরে যাঁরা কাজ দেখবেন তাঁদের বেশির ভাগই রেলের বিষয়ে পটু নন। ফলে কাজ ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে।
রয়েছে জমি অধিগ্রহণের সমস্যাও। প্রথম থেকেই এ রাজ্যের জমি অধিগ্রহণের সমস্যা রয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেস রেল দফতর ছেড়ে চলে আসার পরে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে সমস্যা আরও বেড়ে গিয়েছে। ফলে বিভিন্ন জায়গায় জমিই এখনও পাওয়া যায়নি (বিশেষ করে বাইপাস, হাওড়া, সেন্ট্রাল মেট্রো স্টেশন)। এর মধ্যেই ট্রেনের রাস্তা বদল করার প্রশ্নে রাজ্য সরকারের সঙ্গে রেলের বিরোধ বাধায় লাইন ঠিক কোথা দিয়ে যাবে, তা নিয়ে জট এখনও কাটেনি। পাশাপাশি কেএমআরসি-র প্রশাসনিক কাজকর্মেও সমস্যা প্রচুর। রেল-কর্তাদের অভিযোগ, যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা কেউই রেল বিষয়ক কাজে অভিজ্ঞ নন। কোনও ম্যানেজিং ডিরেক্টর (এমডি) নেই। এমন অবস্থায় এক বছর ধরে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। আর যার জন্য প্রকল্পটি হাতে নেওয়ার পরেও ২০১২-’১৩ আর্থিক বছরের রেল বাজেটেও টাকা বরাদ্দ করা যায়নি। রেল বোর্ডের কর্তাদের বক্তব্য, যে প্রকল্পের কাজ এগোচ্ছে না, সেই প্রকল্পে টাকাও বরাদ্দ করা যায় না। ফলে কলকাতার ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো এখন বিশ বাঁও জলে। |