|
|
|
|
|
|
|
মুখোমুখি... |
|
বিশ্বভারতীর কপিরাইট না উঠলেই ভাল হত |
তা হলে এক্সপেরিমেন্টের নামে রবীন্দ্রসঙ্গীতে এত যথেচ্ছাচার চলত না।
প্রমিতা মল্লিক খোলাখুলি বললেন বিপ্লবকুমার ঘোষ-কে |
পঁচিশে বৈশাখ এলেই বহু অনুষ্ঠানে আপনাকে দেখা যেত। ইদানীং ততটা নয়। কেন?
সত্যিটা বলছি বলে অনেকেই হয়তো আমার উপর রেগে যাবেন। তবুও বলছি পঁচিশে বৈশাখে বহু অনুষ্ঠানে যাওয়ার আমন্ত্রণ পেলেও এখন যাই না অন্য কারণে। যাঁর জন্মদিনে শ্রদ্ধা জানাবার জন্য এত আয়োজন, সেখানে গিয়ে প্রায়ই শুনি, ‘আমি কখন গাইতে বসব? আরও কুড়িটা জায়গায় যেতে হবে’ প্রভৃতি বিভিন্ন শিল্পীর অনর্গল তাগাদা। ওখানে গানের চেয়ে ‘হাজিরা’ দেওয়াটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। এ রকম আমি চাই না, মানতেও পারি না। তাই দু’ থেকে তিনটের বেশি অনুষ্ঠানে যাব না নিয়ম করে ফেলেছি।
শুধু এটাই কারণ? না কি অহংবোধ?
অন্যান্য সময়েও ওই একই নিয়ম মেনে চলি। ধরুন, খুব কষ্ট করে কোথাও অনুষ্ঠান করতে গেলাম। সেখানে হয়তো মেলা হচ্ছে। সবাই আনন্দ করছে, কথা বলছে, কিন্তু গান শুনছে না। সে সব জায়গাতেও যেতে ইচ্ছে করে না। এটা আমার নিজস্ব ভাবধারা, অহংবোধ থেকে নয়।
রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে যে যা খুশি করে যাচ্ছেন। আপনি কি ক্ষুব্ধ?
যখন বিশ্বভারতীর কপিরাইট উঠে গিয়েছিল তখন খুব আনন্দ হয়েছিল। এখন মনে হয় থাকলেই ভাল হত। বহু ক্ষেত্রে এক্সপেরিমেন্টের নামে যথেচ্ছাচার চলে। অনেক অ্যারেঞ্জার শুধু সুরটা মাথায় রেখে যে রকম বাজনা বা আবহ তৈরি করেন, সেটি গানের কথার একেবারে উল্টো। অনেকে মনে করেন তাঁরা রবীন্দ্রসঙ্গীতকে ইমপ্রুভ করছেন। এবং প্রকাশ্যে তা বলেও থাকেন। এই স্পর্ধা ক্ষমার অযোগ্য। অবশ্য ব্যতিক্রমও আছেন কেউ কেউ। যাঁরা বোধ দিয়ে, যত্ন করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন।
শান্তিনিকেতন ছেড়ে কলকাতায় এসেছেন বহু দিন হয়ে গেল। কিন্তু এখনও রবীন্দ্রসঙ্গীতকেই আঁকড়ে বসে আছেন। কেন?
আসলে এই গানকেই আঁকড়ে ধরে রাখা যায়। এই গান এই সুর তো সব সময়ের, সব আবেগের, সুখ-দুঃখের প্রতিফলন। আমরা যতই তাঁকে ধরতে চাই তিনি প্রাণ সুধায় ভরিয়ে দিয়েও আবারও হয়ে যান ‘অধরা’। মনে হয়, ‘হেথা যে গান গাইতে আসা, আমার হয়নি সে গান গাওয়া।’ মাত্র সতেরো বছর বয়সে যে গান নিয়ে কলকাতায় এসেছিলাম, আজ প্রৌঢ়ত্বে সেই একই গান আমার গলায়, ‘আমার শেষ পারানির কড়ি।’ |
|
ছবি: সুব্রত কুমার মন্ডল |
অন্য গান গাইলেও আপনার তৈরি গলায় নিশ্চয়ই খুব জনপ্রিয় হত। সে আধুনিক হোক বা জীবনমুখী। নিজের প্রতি আস্থা নেই? না কি কেউ ডাকেনি আপনাকে?
দেখুন ভাল গাইলেই যে এক জন শিল্পী জনপ্রিয় হবেন, এমন কথা কখনওই বলা যায় না। আমি কিন্তু প্রথম জীবনে রবীন্দ্রসঙ্গীতের বাইরেও অন্য গান যথেষ্টই গেয়েছি। সে ইংরেজি গান হোক বা হিন্দি গান। আধুনিকও গাইতাম। যে কোনও গানেই আমার আস্থা আছে। কিন্তু সত্যি বলছি সে রকম সুযোগ আসেনি। তাই অন্য রকম গান গাইবার কথা কখনও সিরিয়াসলি চিন্তা করিনি।
এক সময়ে তো আপনি এবং আরও কয়েক জন মিলে একটা গানের দল তৈরি করেছিলেন না?
নাচ-গানের দল খুলেছিলাম। নাম দিয়েছিলাম ‘স্ট্র্যাডিভেরিয়াস’। আমরা প্রচুর লোকসঙ্গীত গাইতাম। অনুষ্ঠানও করেছি। ইন্দ্রাণী সেনও নিয়মিত গেয়েছেন এই দলে। কিন্তু পরে ব্যস্ততা বাড়ায় আমি দল থেকে বেরিয়ে আসি।
সেই দল মমতাশঙ্কর ব্যালে ট্রুপ, তাই না?
ঠিক তাই। চন্দ্রোদয় ও মমতাশঙ্করের তখন সবে বিয়ে হয়েছে। সেই থেকে ওঁরাই এই দলটিকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যান।
আপনি কি অনেক আগেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে বাংলা আধুনিক গানের ভবিষ্যত্ খুব উজ্জ্বল নয়?
না না, আমি কিছুই উপলব্ধি করিনি। আসল ঘটনাটা কী জানেন? আমার গলার আওয়াজটা একটু গম্ভীর। তাই মনে হয়েছিল আমার গলায় আধুনিক গান মানাবে না। তাই আধুনিক গানে নিজেকে জড়াতে চাইনি।
শান্তিনিকেতনে থাকতেই আপনার গান দ্রুত প্রচার এবং প্রশংসা পেয়েছিল। তবুও কেন আপনাকে কলকাতাতে চলে আসতে হল?
অনেকেই এটা ভুল করেন। ওখানে বিশ্বভারতীর অনুষ্ঠানে, রেডিয়োর প্রোগ্রামে গাইতাম। ওইটুকুই যা। শান্তিনিকেতনের বাইরে ক’জনই বা চিনত আমাকে? আর প্রচার পাওয়ার জন্য কলকাতাতে চলে এলাম এটা অনেকেই ভাবেন। আরে না। বাবা বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগের অধ্যক্ষ হিসেবে কলকাতায় ছিলেন। কিন্তু ওঁর খুবই শরীর খারাপ হতে থাকায় মা আমাদের নিয়ে চলে আসতে বাধ্য হন। এর সঙ্গে গানের কোনও সম্পর্কই নেই।
বহু বার বিদেশে গিয়েছেন। ওখানকার শ্রোতারা কি অন্য গানের অনুরোধ করেন না?
বিদেশে তিন ধরনের শ্রোতার জন্য তিন ভাবে অনুষ্ঠান করতে হয়। কোথাও বা শুধুই রবীন্দ্রসঙ্গীত, কোথাও পাঁচমিশেলি। আমেরিকাতে একবার এক অনুষ্ঠানে ‘সাধের লাউ’ গাইতে হয়েছিল। আরেক বার ইংল্যান্ডে ‘দূরে কোথায় দূরে দূরে’ শুনে শ্রোতারা যখন উচ্ছ্বসিত, তখনই এক শ্রোতা উঠে দাঁড়িয়ে কী অনুরোধ করেছিলেন শুনবেন? ‘দিদি একটা ভাংরা শোনাবেন প্লিজ?’। আমি অবাক।
শিল্পীদের নিয়ে কত না রটনা ও ঘটনা। কিন্তু আপনি সব কিছুর অন্তরালে।
(হাসতে হাসতে) সারা দিন এত ব্যস্ততার মধ্যে কাটে যে অন্য কোনও দিকে নজর দিতে পারি না। |
|
|
|
|
|