পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিন নিয়ে রাজ্য সরকার এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশনের মধ্যে ঐকমত্য হলেও জেলাবিন্যাস নিয়ে মতবিরোধ থেকেই গেল।
মহাকরণ সূত্রে খবর, জুলাইয়ের ২, ৬ এবং ১০ তারিখ ভোট এবং ১৩ তারিখ গণনা করার যে প্রস্তাব কমিশন দিয়েছিল, রাজ্য সরকার তা মেনে নিয়েছে। কিন্তু প্রথম দু’দফায় দক্ষিণ ও মধ্য বঙ্গের ৬টি করে জেলা এবং তৃতীয় পর্যায়ে ৫ জেলায় ভোট করতে চেয়ে কমিশনের প্রস্তাব তারা মানতে রাজি হয়নি। রাজ্য চায়, প্রথম দফায় কলকাতায় আশপাশের ৬টি এবং জঙ্গলমহলের তিন জেলায় ভোট হোক। বাকি ৮ জেলায় ভোট হোক পরবর্তী দুই পর্যায়ে। কমিশন আপত্তি জানালেও এই বিন্যাসের কথা বলেই আজ, শুক্রবার বিজ্ঞপ্তি জারি করে দেবে রাজ্য সরকার। কারণ, হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ মঙ্গলবার দেওয়া নির্দেশে শুক্রবারের মধ্যে বিজ্ঞপ্তি জারি করতে বলেছে।
তার পর নির্বাচন কমিশন কী করবে? রাজ্য সরকারের বিজ্ঞপ্তি জারির পরে কমিশনের বিজ্ঞপ্তি জারি করার কথা। তার পরেই শুরু হবে নির্বাচন প্রক্রিয়া। কিন্তু কমিশনের সচিব তাপস রায় এ দিন বলেন, “সরকার বিজ্ঞপ্তি জারি করলেই কমিশনও যে বিজ্ঞপ্তি জারি করবে, তা বলা যায় না। আইনে রয়েছে কার্যকর আলোচনার ভিত্তিতে নির্বাচনের দিন ঘোষণা করতে হবে। তা না হলে কমিশন তা পুনর্বিবেচনার জন্য সরকারের কাছে ফেরত পাঠাতে পারে।”
কমিশন সূত্রে আরও একটি জটিলতার কথা এ দিন বলা হয়েছে। ডিভিশন বেঞ্চ তাদের নির্দেশে গ্রাম পঞ্চায়েত নির্বাচনের নির্ঘণ্ট প্রকাশ করার কথা বলেছে। সে ক্ষেত্রে পঞ্চায়েত সমিতি এবং জেলা পরিষদের ভোট নিয়ে কী হবে, সেই প্রশ্ন তুলেছে কমিশন। রাজ্য সরকারের তরফে অবশ্য কমিশনকে বোঝানোর চেষ্টা হয় যে, আদালত আসলে ত্রিস্তর ভোটের কথাই বোঝাতে চেয়েছে। কমিশন জানিয়েছে, আজ, শুক্রবার আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত মতামত জানানো হবে।
তবে মূল মতানৈক্য অবশ্য জেলাবিন্যাস নিয়েই। এ দিন কমিশনের দফতরে গিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডের সঙ্গে দেড় ঘণ্টা বৈঠক করেন মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র এবং স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়। তার আগে মহাকরণে গোড়ায় পঞ্চায়েতসচিব এবং পরে রাজ্য পুলিশের ডিজি, এডিজি আইনশৃঙ্খলার সঙ্গে বৈঠক করেন তাঁরা। মীরা পাণ্ডের সঙ্গে বৈঠকে কমিশনের তরফে জেলা বিন্যাসে সমতা রক্ষার কথা বলা হয়। কারণ, তাদের মতে, জেলাবিন্যাসে সমতা না-থাকলে নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েনে সমস্যা হবে। কিন্তু রাজ্য সরকারের তরফে বলা হয়, কলকাতার লাগোয়া ৬ জেলায় কলকাতার পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা সম্ভব। আর জঙ্গলমহলের তিন জেলায় এমনিতেই বাড়তি পুলিশ বাহিনী এবং কেন্দ্রীয় বাহিনী রয়েছে। ফলে এই ৯ জেলায় এক দিনে ভোট করে ফেলতে কোনও অসুবিধা নেই।
বাকি দু’দিনে চারটি করে জেলায় ভোট হলে রাজ্য পুলিশই যথেষ্ট। রাজ্য প্রশাসনের এক মুখপাত্র জানান, রাজ্যের হাতে যে সংখ্যক পুলিশ রয়েছে এবং গত দু’বছরে ভিলেজ পুলিশ, সিভিক পুলিশ, হোমগার্ড-সহ যে কয়েক হাজার নিয়োগ হয়েছে, তাঁদের নামালে আর ভিন্ রাজ্যের পুলিশও প্রয়োজন হবে না। সে ক্ষেত্রে দ্বিতীয় পর্যায়ে কংগ্রেস প্রভাবিত মুর্শিদাবাদ, মালদহ জেলার সঙ্গে নদিয়া ও বীরভূম আর তৃতীয় পর্যায়ে উত্তরবঙ্গের বাকি চার জেলায় ভোট করা যেতে পারে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এমনটাই চান বলে মহাকরণ সূত্রের খবর।
পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় এ দিন বলেন, “কমিশন যে তিন দিন ভোট চেয়েছিল, তা মেনে নেওয়া হয়েছে। আশা করব সরকারের বিজ্ঞপ্তি
মেনে নিয়ে কমিশন পাল্টা বিজ্ঞপ্তি জারি করবে।” সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী নিয়ে কী হবে? সুব্রতবাবু বলেন, “এ ব্যাপারে রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের সঙ্গে আলোচনা করে কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে। আদালত তো স্পষ্ট নির্দেশিকা দিয়েই দিয়েছে। ফলে এ ক্ষেত্রে কোনও জটিলতা নেই।”
কিন্তু রাজ্য পুলিশের অধীনে ভোটে যে তাঁদের যে আস্থা নেই, তা এ দিন আরও এক বার স্পষ্ট করে দিয়েছেন বিরোধীরা। সিপিএম রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু বলেন, “রাজ্যে যে ভাবে নৈরাজ্য চলছে, তা রুখতে রাজ্য পুলিশের ভূমিকা যে যথেষ্ট নয়, তা স্পষ্ট।” আর বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের মন্তব্য, “সরকারের ইচ্ছা, সদিচ্ছা, বদিচ্ছা কী আছে, তার উপরেই নির্ভর করছে সব কিছু! শুধু আইন, বিল, রায় এ সব দিয়ে হয় না। আসলে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা। যদি অচলাবস্থা না কাটে,
তার দায় রাজ্য সরকারের
উপরেই বর্তাবে।”
বিরোধীদের এই আক্রমণের জবাবে পঞ্চায়েতমন্ত্রী বলেন, “রাজ্য সরকারের দায় রয়েছে বলেই তো কমিশনকে বলেছি, শুধু রাজ্য পুলিশ দিয়ে এবং আমাদের প্রস্তাবিত জেলাবিন্যাস মেনে নিয়ে ভোট করুন। তাতে শান্তিতেই ভোট হবে।” সুব্রতবাবুর পাল্টা প্রশ্ন, ৮০০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী এনেও এক জনও খুন হবে না, এই গ্যারান্টি সূর্যকান্তবাবু বা কমিশন দিতে পারবেন কি?
ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশমতো এ দিনই নির্বাচন কমিশনের কাছে মোট ৩৬৫ জন পর্যবেক্ষকের তালিকা জমা দিয়েছে রাজ্য সরকার। বাকি ৬৫ জনের তালিকা আজ, শুক্রবার জমা দেওয়ার কথা। মহাকরণ সূত্রে বলা হচ্ছে, কমিশনের দাবি মানতে গিয়ে
এ বারই প্রথম কর্মাসিয়াল ট্যাক্স অফিসার এবং ফরেস্ট সার্ভিসের অফিসারদের পযর্বেক্ষক হিসেবে নিয়োগ করা হচ্ছে।
আজ, শুক্রবার কমিশনের পক্ষ থেকে সর্বদলীয় বৈঠক ডাকা হয়েছে। শনি ও রবিবার বৈঠক হবে জেলাশাসক এবং ১৭টি জেলার এসপি-দের নিয়ে বৈঠক ডেকেছেন।
|