মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে বাষ্পচালিত রেল ইঞ্জিনের গুরুত্ব অস্বীকার করিবে কে? গুটেনবার্গের ছাপাখানার মহিমাও একই রকম অনস্বীকার্য। কিন্তু ঐতিহাসিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলিয়াই তাহাদের আজও ব্যবহার্য জ্ঞান করিতে হইবে, এমন দাবি সেই ইঞ্জিন অথবা ছাপাখানা করে নাই। তাহাদের সসম্মান জাদুঘরে স্থান হইয়াছে। তাহাই ধর্ম। সেই ধর্ম হইতে বিচ্যুত হইলেই অকুশলতাকে ঠাঁই করিয়া দেওয়া হয়। এই ধর্মচ্যুতি ভারতীয়দের, বিশেষত বাঙালির, স্বভাবগত। এক কালে শহর কলিকাতার রূপায়ণে ক্যালকাটা (কলকাতা) ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট বা কে আই টি নামক সংস্থাটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তাহা অতীত। কলিকাতার নাগরিক ইতিহাসে উত্সাহী কোনও ছাত্র এই সংস্থাটির বিষয়ে আগ্রহী হইতেও পারেন। সংস্থাটি এক সময় উল্টোডাঙা অথবা ঢাকুরিয়ার ন্যায় অঞ্চল গড়িয়া তুলিয়াছিল। তাহা ছিল প্রায় জুরাসিক যুগের সমকাল। তখন ‘কমান্ডিং হাইটস’ বলিলে সরকারি উদ্যোগের নেতৃত্ব বুঝাইত, এখন শুনিলে মনে হয় বুঝি কোনও গগনভেদী আবাসন প্রকল্পের নাম। ইহা একুশ শতক। এখন নগরনির্মাণের উদ্দেশ্য বিধেয় সব বদলাইয়া গিয়াছে। সি আই টি তথা কে আই টি-র পুরানো অবতারটি এই যুগে বেমানান।
কর্তারা কথাটি, বহু বিলম্বে হইলেও, সম্ভবত বুঝিয়াছেন। ফলে কে আই টি-কে প্রকৃত অর্থে স্বাবলম্বী করিবার চেষ্টা আরম্ভ হইয়াছে। সংস্থার কর্তারা বিভিন্ন মন্ত্রকে চিঠি পাঠাইয়া কাজ চাহিতেছেন। স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টাটি অতি জরুরি। সংস্থাটিকে যদি একান্তই টিকাইয়া রাখিতে হয়, তবে তাহা এই পথেই করিতে হইবে। কিন্তু প্রথমেই স্থির করিয়া লওয়া প্রয়োজন যে কে আই টি সরকারি সংস্থা বলিয়াই তাহাকে বাড়তি সুবিধা দেওয়া হইবে না। বাজারে আর পাঁচটি সংস্থা যে পদ্ধতিতে কাজের বরাত পাইয়া থাকে, এই সংস্থাটিকেও সেই পথেই কাজ জোগাড় করিতে হইবে। সরকারি সংস্থাকে সরকারি কাজের বরাত পাওয়াইয়া দিবার কুফল কী, তাহা এখনও উল্টোডাঙায় কেষ্টপুর খালের দিকে তাকাইলেই দেখা যাইবে। উড়ালপুলের ভাঙিয়া পড়া অংশটি এখনও একই ভাবে পড়িয়া আছে। কেন পুলটি ভাঙিয়াছিল, সেই কারণ খুঁজিতে গিয়া এমন অনুমান জোরদার হইয়াছে যে, একটি সরকারি সংস্থা ন্যূনতম অর্থেরও কম খরচে পুলটি নির্মাণে সম্মত হইয়াছিল। ইহা সরকারি সংস্থার একটি ব্যাধি, একমাত্র ব্যাধি নয়।
দ্বিতীয় কথা, শুধুমাত্র সরকারি কাজের মধ্যে আটকাইয়া থাকিলেই চলিবে না। সংস্থার আদৌ যদি কোনও দক্ষতা থাকে, তাহাকে বাজারে বেচিয়া প্রমাণ করিতে হইবে। অন্য ভাবে বলিলে, অন্যান্য বেসরকারি সংস্থা যে ভাবে কাজ করে, কে আই টি-কেও তাহাই করিতে হইবে। যথার্থ বাজার সরকারি বা বেসরকারি সংস্থাকে চেনে না, চিনিবার কথা নয়। সংস্থাটি যদি তেমন বাজারে টিকিতে পারে, ভাল নচেত্ জাদুঘরের অভাব নাই। ভবিষ্যতের কলিকাতা-গবেষকরা যাহাতে কে আই টি সংক্রান্ত তথ্য সহজেই খুঁজিয়া পান, তাহা নিশ্চিত করিলেই চলিবে। |