মা চোলাইয়ের ঠেকে এঁটো গ্লাস মেজে পয়সা পেতেন। ভাই বেচত চোলাইয়ের চাট। সময়ে সময়ে মা-কে সাহায্য করতে গ্লাস মেজেছেন কুহেলি। কিন্তু উত্তর ২৪ পরগনার হাবরা রেল কলোনির ঝুপড়িবাসী তরুণী চালিয়ে গিয়েছেন পড়াশুনোটাও। হাবরা চৈতন্য কলেজ থেকে বিএ পাশ করা মেয়েটি অবশ্য জীবন-যুদ্ধের এই পর্বেই থেমে যাননি। সমবয়সী কয়েকজনকে জুটিয়ে, চোলাই-ব্যবসায় জড়িতদের বুঝিয়ে পাল্টে দিয়েছেন এলাকার চেহারা। মা-ভাই তো বটেই, এলাকায় ৪০ বছর ধরে চোলাই ব্যবসা চালানো মহিলাও রয়েছেন কুহেলির বোঝানোয় সুস্থ জীবনে ফিরে আসাদের তালিকায়।
কুড়ি বছর আগে বাবা মারা গিয়েছেন কুহেলি সেনের (নাম পরিবর্তিত)। নুন আনতে পান্তা ফুরনোর সংসারে রোজগার বলতে মা-র আয়। হাবরা রেল কলোনির ঝুপড়িতে এক সময় চোলাই ব্যবসার অবিসংবাদী মালকিন ঊর্মিলা বসু ওরফে ছোড়দির ঠেকে গ্লাস মাজতেন মহিলা। সে সময় কলোনির শ-পাঁচেক ঘরের মধ্যে পঁচিশটিরও বেশি থেকে মিলত চোলাই। ঠেকগুলোকে ঘিরে একের পর এক অপরাধ হয়ে চলেছিল হাবরা স্টেশন চত্বরে। কয়েক বছর আগে রেলওয়ে কলোনির এক কলেজ ছাত্রীকে চোলাই-ঠেকে আসা মদ্যপেরা উত্যক্ত করে। |
প্রতিবাদ করায় মেয়েটির বাড়িতে চড়াও হয়ে তার উপরে অত্যাচার করে দুষ্কৃতীরা। অপমানিত ছাত্রীটি আত্মঘাতী হন। বছর দু’য়েক আগে মদ খাওয়ার টাকা চেয়ে না পেয়ে হাবরা প্ল্যাটফর্মের এক চায়ের দোকানিকে বেধড়ক মারধর করে মদ্যপেরা। মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়াই বন্ধ হয়ে যায় দোকানি কিশোরটির। কলোনির মধ্যেই চোলাই ছাড়াও, রমরমিয়ে চলা সাট্টা-জুয়ার কারবারেরও প্রতিবাদ করার সাহস পেতেন না কেউই।
কুহেলি প্রতিবাদ করেন। সঙ্গে এলাকার বাসিন্দা আর এক তরুণী এবং চৈতন্য কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের দুই ছাত্র। কুহেলির কথায়, “মা অনেক কষ্ট করে আমাকে পড়িয়েছেন। কিন্তু পড়াশোনা করতে গিয়েই চোখ খুলল। বুঝলাম, চোলাই ব্যবসার সঙ্গে অসামাজিক কাজকর্মের এমন একটা যোগ আছে, যেটা আমাদের এলাকার পরিবেশটাকে কখনও সুস্থ হতে দেবে না। অস্বীকার করব না, কোথায় থাকি, মা কী করেনএ সব বন্ধুদের জানাতে অস্বস্তি হত। ভাবতাম, এই পরিস্থিতি বদলানো যায় না!” কলেজে একই এলাকার বাসিন্দা বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কুহেলি দেখেন, তাঁদেরও অনেকে একই ভাবনার শরিক। ব্যস, কাজ শুরু। প্রথম বাধা, বাড়িতে বোঝানো। কুহেলির মা বলেন, “গ্লাসপিছু পয়সা পেতাম। দৈনিক আয়টা নিশ্চিত ছিল। কিন্তু মেয়ে ধরে পড়ল।” মায়ের থেকেও বড় বাধা ‘ছোড়দি’। ষাটোর্ধ্ব মহিলা বললেন, “প্রথমে ফটকে ছুঁড়ি-ছোঁড়াগুলোর কথায় পাত্তাই দিইনি। কিন্তু মুখঝামটা খেয়েও ওরা দমেনি। রোজ এসে ঘানঘ্যান করত, ‘ব্যবসা ছেড়ে দাও। শান্তিতে থাকবে। সম্মান পাবে’। প্রথমে রাগ হত। আস্তে আস্তে বুঝলাম, ওরা আমাদের ভাল চায়। বিশেষ করে ওই কুহেলি মেয়েটা।”
তরুণ ব্রিগেডের ওই উদ্যোগ জেনে পাশে দাঁড়ায় পুলিশ-প্রশাসন এবং কলোনিরই একটি ক্লাব। পুরপ্রধান, থানার আইসি, বিডিও-কে নিয়ে সর্বদল সভা হয়। এখন অসামাজিক কাজকর্ম বন্ধ ওই এলাকায়। কুহেলির মা, ‘ছোড়দি’ এবং এলাকায় চোলাই ব্যবসায় জড়িত অনেক দিদি-মাসি-কাকিমা (সংখ্যাটা প্রায় ২৫ জন) এখন সাইকেল গ্যারাজ চালান। ১০ বছর ধরে চোলাই বিক্রি করতেন খোকন দাস। নিজেই বললেন, “এখন মাথা উঁচু করে হোটেলে কাজ করি।” চোলাইয়ের নেশা ছেড়ে ভাল আছেন বলে জানালেন এলাকার পরিতোষ বসু, প্রকাশ সাহানিরা। হাবরার পুরপ্রধান তপতী দত্ত বলেন, “কুহেলিদের জন্য ওখানে অসম্ভবকে সম্ভব করা গিয়েছে। ব্লক ও পুরসভা মিলে ওই কলোনির বাসিন্দাদের জন্য কিছু করার পরিকল্পনা রয়েছে।” |