মোবাইল ফোনে একটা মিস্ড কল। সেই থেকে প্রেম। তার পরেই বিয়ের টোপ। সেই ফাঁদে পা দিতেই নিষিদ্ধপল্লিতে বিক্রি করে দেওয়া। সেখানে পৌঁছে অকথ্য অত্যাচার।
পুলিশের দাবি, মোবাইলে মিস্ড কল দিয়ে মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে তাদের পাচার করার কৌশল নিয়েছে পাচারকারীরা। পাচার চক্রের জাল ছড়িয়ে রয়েছে মুর্শিদাবাদ থেকে মহারাষ্ট্র পর্যন্ত। মহারাষ্ট্রের পুণে শহরের বুধওয়ার পেট এলাকার একটি নিষিদ্ধপল্লি থেকে রেজিনগরের নবম শ্রেণির এক ছাত্রীকে দিন পাঁচেক আগে উদ্ধার করার পরে এই সব তথ্য জানতে পেরেছে মুর্শিদাবাদ জেলা পুলিশ। ওই কিশোরীকে দিনে অন্তত ৩ জন ‘খদ্দের’-এর সঙ্গে কাটাতে হত। আপত্তি করলে কপালে জুটত মার। খাওয়া-দাওয়ার জন্য খদ্দের পিছু মাত্র ৫০ টাকা তার হাতে দেওয়া হত।
উদ্ধার হওয়া কিশোরী পুলিশকে জানিয়েছে, মিস্ড কলের সুবাদে তার মতো ভুয়ো প্রণয়ের ফাঁদে পড়ে পাচার হয়েছে আরও অনেক মেয়ে। এ রকম জনা চারেক বাঙালি কিশোরীর সঙ্গে পুণের নিষিদ্ধপল্লিতে তার দেখা হয়েছে। তাদের বাড়ি কলকাতার লাগোয়া এলাকায়। ওই চার জনের প্রত্যেককে ৩৫ হাজার টাকায় পাচারকারীরা ওই নিষিদ্ধপল্লিতে বিক্রি করে দিয়েছে বলে পুলিশ জানতে পেরেছে। মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর বলেন, “ওই মহিলাদেরও উদ্ধারের চেষ্টা হবে।”
ওই কিশোরীকে উদ্ধার করার পাশাপাশি নারী পাচার চক্রের চার পান্ডাকেও পুলিশ গ্রেফতার করেছে। ধৃতদের মধ্যে তিন জন মহিলা। ওই তিন জনের মধ্যে রাধিকা রাও নামে এক মহিলা আবার পুণের নিষিদ্ধপল্লিটির মালকিন। বছর পঁয়ত্রিশের রাধিকার বাড়ি হায়দরাবাদে। ‘ট্রানজিট রিমান্ড’-এ পুণে থেকে নিয়ে আসার পর বুধবার তাকে বহরমপুর আদালতে হাজির করে পুলিশ। ধৃত অন্য তিন জনের মধ্যে রয়েছে ৬৮ বছরের অঞ্জলি বিশ্বাস, তার ছেলে বছর সাতাশের বান্টি এবং পিঙ্কি বিশ্বাস। বান্টিদের বাড়ি উত্তর ২৪ পরগনার ব্যারাকপুর। বছর কুড়ির পিঙ্কি উত্তর ২৪ পরগনার ঘোলা থানা এলাকার বাসিন্দা। ধৃতদের কাছ থেকে ১২টি সিমকার্ড এবং ৭টি মোবাইল ফোন পুলিশ বাজেয়াপ্ত করেছে।
রেজিনগরের বছর পনেরোর ওই কিশোরীটি জানিয়েছে, তার মোবাইলে আসা মিস্ড কলের সূত্র ধরে মাস তিনেক আগে রাহুল চৌধুরী নামে এক যুবকের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়। দেখা না হলেও ফোনালাপে দু’জনের প্রেম শুরু হয়। রাহুল তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। রাহুলের কথা মতো গত ২৯ মার্চ ওই কিশোরী শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছয়। পুলিশ সুপার বলেন, ‘‘রাহুল কিশোরীটিকে ফোনে জানায়, সে বহরমপুরে ফিরে গিয়েছে। সে যেন ২০ নম্বর ও ২১ নম্বর টিকিট কাউন্টারের মাঝে দাঁড়াতে বলে। সবই চলছিল পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক।”
সেই ছকেরই অংশ হিসাবে শিয়ালদহে কিশোরীটির সঙ্গে ভাব জমায় পিঙ্কি দাস। ওই কিশোরীর কথায়, “পিঙ্কি আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার নামে ব্যারাকপুরে নিয়ে যায়। সেখান থেকে শেওড়াফুলি। সঙ্গে জুটে যায় বান্টি আর তার মা। মায়ের সঙ্গে আমাকে কয়েক সেকেন্ড কথা বলতে দেয় পিঙ্কি।’’
পুলিশ সুপার বলেন, “ব্যারাকপুর থেকে কিশোরীকে সোনগাছিতে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করার চেষ্টা করে অঞ্জলি, পিঙ্কি ও বান্টি। সেখানে কাজ না হওয়ায় তাকে নিয়ে তারা সোজা চলে যায় পুণেতে। রাধিকার কাছে ৪০ হাজার টাকায় কিশোরীকে বিক্রি করে দেয় বান্টি।” বুধবার বহরমপুর আদালত চত্বরে রাধিকা নিজেই বলেন, “এর আগে ৩৫ হাজার টাকা করে চার জন বাঙালি মেয়েকে কিনেছি।’’ উদ্ধার হওয়া কিশোরী বলে, “ওই চারটি মেয়ের কাছে জেনেছি, তাদেরও রাহুল, বান্টিরা একই ভাবে মোবাইল ফোন থেকে প্রথমে মিস্ড কল দিয়েছিল। পরে বিয়ে করার টোপ দিয়ে তাদের বিক্রি করে দেয়।” পুলিশ জানায়, কিশোরীটি যে মোবাইল ফোনে মায়ের সঙ্গে কথা হলেছিল তা ছিল পিঙ্কির। সেই ফোনের সূত্র ধরেই অঞ্জলি, পিঙ্কি ও বাণ্টিকে ধরা হয়। উদ্ধার হয় কিশোরী।
পুলিশ সুপার জানান, মিস্ড কলের মাধ্যমে প্রেমের অভিনয় করে ১৪ থেকে ১৭ বছরের কিশোরীদের পাচার করা হচ্ছে। |