|
|
|
|
অঙ্কে নয়, হেরেই বিদায় চ্যাম্পিয়নদের |
নাইটদের এখন ক্রিকেট সরঞ্জাম ছুড়ে ফেলার পালা
প্রিয়দর্শিনী রক্ষিত • রাঁচি |
সিঁড়ির উপর সওয়া ছ’ফুটের চেহারাটা কুঁজো হয়ে বসে। চোখমুখ ক্রুদ্ধ। দৃষ্টি মাঠে আটকে। দেবব্রত দাসের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝিতে রজত ভাটিয়ার রান আউটটা বিশ্বাস করতে পারলেন না যেন। মুষ্টিবদ্ধ হাত সজোরে আছড়ে পড়ল রেলিংয়ে।
ম্যাচ শেষ হতে কোথাও আর দেখা গেল না তাঁকে। মাঠে ঢুকেও না। কোথায় গেলেন? গৌতম গম্ভীর যখন বিধ্বস্ত চোখমুখে বলে যাচ্ছেন, “এ রকম আউট কেরিয়ারে কখনও দেখিনি। পাঠান যা খেলছিল, আজ জিতে ফেরা উচিত ছিল...” তখন ইউসুফ কোথায়? কী করছেন? নিজেকে অভিশাপ দিচ্ছেন?
ক্রিকেটে অদ্ভুত আউট নতুন কিছু নয়। ম্যানুয়াল ঘাঁটলে উঠে আসবে একের পর এক উদাহরণ। ‘অবস্ট্রাক্টিং দ্য ফিল্ড’ সে রকমই একটা প্রজাতির। প্রায় বিলুপ্ত। যা বুধবারের রাঁচিতে ইউসুফের মারণযজ্ঞ এক ঝটকায় থামিয়ে তো দিলই, একই সঙ্গে টুর্নামেন্ট থেকেও ছুটি করে দিল কেকেআরের। শেষ পর্যন্ত পা কাটল পচা শামুকে। যে পুণে ওয়ারিয়র্স ঠিক এক মাস আগে আইপিএলে শেষ বার জিতেছিল, তারা আজ অপ্রত্যাশিত ভাবে গুঁড়িয়ে দিল নাইটদের প্লে-অফ স্বপ্ন।
ঠিক কী হয়েছিল?
ঘড়ি বলছে, সন্ধে সাতটা দশ। স্কোরবোর্ড বলছে, ১৮ বলে চাই ৩৭। ওয়েন পার্নেলের তিনটে বল মুহূর্তে উড়ে গেল বাউন্ডারির বাইরে। চার, ছয়, চার। থরথরিয়ে কাঁপছে গ্যালারি, বহু দিন পরে সেই চেনা জান্তব গর্জন: ইউসুফ...উই ওয়ান্ট সিক্সার...উই ওয়ান্ট সিক্সার...। কে জানত, মাত্র একটা মিনিট, একটা বলে চুরমার হয়ে যাবে যাবতীয় স্বপ্ন?
পার্নেলের বলটা ব্যাটে ঠেকিয়ে হঠাৎই সিঙ্গল নেওয়ার অহেতুক চেষ্টায় ঝাঁপ দিলেন পাঠান। বোলার বলের নাগাল পেলে নিশ্চিত রান আউট। ‘মৃত্যু’ভয়ে ভীত পাঠান বলটা গার্ড তো করলেনই, শেষে আবার জুতো দিয়ে ঠেলে সরিয়েও দিলেন। মিনিটখানেক পর আম্পায়ারের আঙুল যখন উঠল, তখনও তাঁর চোখমুখে একরাশ অবিশ্বাস। ডাগআউটে ফিরে ব্যাট, হেলমেট ছুড়ে ফেলে উত্তেজিত ভাবে কী সব বোঝাতে শুরু করলেন ট্রেভর বেলিসকে। কিন্তু বুঝিয়েও বা কী লাভ তখন? |
|
|
পোলার্ড বললে পোলার্ড। গিলি বললে গিলি। বুধবারের রাঁচিতে কেকেআরের ভরসা এবং ভাগ্যের এক, দুই এবং তিন নম্বর নাম তিনিই ছিলেন। ৪৪ বলে ৭২ রানের ইনিংসটা যদি আরও কিছুক্ষণ চলত, তা হলে কী হত বলা যায় না। কিন্তু পাঠানের দুর্ভাগ্য, তাঁর টিমে এক জন আজহার মেহমুদও নেই। আছেন এমন কিছু লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যান যাঁরা বোলার একই জায়গায় বল ফেলছে দেখেও পরপর মিস করে যাবেন। যেমন রজত ভাটিয়া। আছেন এমন এক বিদ্রোহী ক্রিকেটার, যিনি টুইট করেন যে গতিতে, টিমের দরকারের সময় আউট হন একই দ্রুততায়। যেমন মনোজ তিওয়ারি। পাঠানের নিজেকেও আজ ক্ষমা করার কথা নয়। তবু যতটুকু যা করার তিনিই করেছেন। কিন্তু মনোজদের দেখে মনে প্রশ্ন জাগে যে, এঁদের সত্যিই কেকেআরের জার্সি পরার যোগ্যতা আছে তো? ১৪ বলে ২৩ যাঁরা তুলতে পারেন না, টিমের সবচেয়ে প্রয়োজনের মুহূর্তে যাঁরা টিমকে ডুবিয়ে ফেরার সময়ও নির্বিকার ভাবে চুইং গাম চিবোতে পারেন, তাঁদের কোনও ফ্র্যাঞ্চাইজির জার্সি পরারই যোগ্যতা আছে কি? রাতে রায়ান টেন দুশখাতেও আক্ষেপ করছিলেন, “এক জন ফিনিশারের অভাব আমাদের ডুবিয়ে দিল।”
শোনা গেল ড্রেসিংরুমে ফিরে উত্তেজিত গম্ভীর নাকি নিজের যাবতীয় ক্রিকেট সামগ্রী ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন। তাঁর ক্ষোভ, ক্রোধ, বিরক্তি খুবই স্বাভাবিক। রাঁচির উইকেট দু’দিন আগের আরসিবি ম্যাচের মতো ছিল না। এখানে ১৭০ তাড়া করে জেতা বিরাট কোনও ব্যাপার নয়। আর সেটাও কিনা করতে হত লিগ টেবিলের ন’নম্বর টিমের বিরুদ্ধে! কিন্তু অযথা প্যানিক বাটন আগেভাগে টিপে দিলে যা হয়। ওভারপিছু আট, সাড়ে আটের আস্কিং রেট তাড়া করতে হলে উচিত হারাকিরি না করে উইকেটটা বাঁচিয়ে রাখা। কিন্তু টিমটার নাম তো কেকেআর! অন্য টিমের কাছে যা নিয়ম, এই টিমে সেটা ব্যতিক্রম। উদাহরণ চার ওভার পেরোতে না পেরোতে কেকেআর ২৯-৩। প্রথমে বিসলা। মাঝে কালিস। শেষে অধিনায়ক নিজে।
আসলে পাড়া-পড়শিদের নিয়ে বেশি ভাবনাচিন্তা করাতেই বোধহয় নিজেদের কাজের উপর থেকেই ফোকাস সরে গিয়েছিল। পেপসি আইপিএলে বরাবরই যা ভুগিয়ে এসেছে কেকেআরকে। অনেক ক্লোজ ম্যাচ হারতে হয়েছে। আইপিএল ফাইভে টিমের নিউক্লিয়াস ছিলেন যে তিন, তাঁদের মধ্যে গম্ভীর-কালিসের অফ ফর্ম। নারিন গত বার চমক ছিলেন, এ বার মাঝে মাঝেই ‘প্রেডিক্টেবল’ হয়ে গেলেন। “আমরা ভাল ক্রিকেট খেলিনি। ধারাবাহিকতা দেখাতে পারিনি। কড়া ওষুধের মতো এটাও হজম করা কঠিন,” ম্যাচ শেষে বলছিলেন গৌতম গম্ভীর।
প্রায় বাকরুদ্ধ, অসীম যন্ত্রণাকাতর নাইট অধিনায়ককে দেখলে, পরিস্থিতির কথা ভাবলে ‘আবার অরণ্যে’-র একটা সংলাপ মনে পড়বে। যেখানে ক্যানসারে আক্রান্ত এক চরিত্র বলছেন, “আজকের পর থেকে এই পৃথিবীতে ফুল, গাছ, পাখি সব থাকবে। শুধু আমি থাকব না।”
কলকাতারও তো তাই। ইডেনে এর পরেও আইপিএল প্লে অফ থাকবে, আইপিএল ফাইনাল থাকবে। শুধু কেকেআর থাকবে না। |
|
|
|
|
|