|
|
|
|
সম্পাদকীয় ১... |
জরুরি বনাম গুরুত্বপূর্ণ |
কলিকাতা হাইকোর্ট কি জরুরি কাজ করিতে গিয়া গুরুত্বপূর্ণ কাজটি বাকি রাখিয়া দিলেন? জরুরি অর্থ, যাহা ‘আরজেন্ট’ বা আশু করণীয়। গুরুত্বপূর্ণ বলিতে বুঝায় ‘ইমপরটান্ট’। যাহা জরুরি, তাহার সহিত অনেক সময়েই যাহা গুরুত্বপূর্ণ, তাহার পার্থক্য থাকে। দৈনন্দিন জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাকি থাকিয়া যায়, কারণ মানুষ জরুরি কাজটির প্রতিই সমস্ত মন ও শক্তি সমর্পণ করে। তাহাতে আশু প্রয়োজন মেটে, দীর্ঘমেয়াদি এবং মৌলিক পরিবর্তন ঘটে না। পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচন জরুরি— এই আশু প্রয়োজনটির প্রতি মহামান্য আদালত যদি বিশেষ মনোযোগ করিয়া থাকেন, তাহা নিশ্চয়ই সঙ্গত। কিন্তু তাহার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক প্রশ্নকে তাহার প্রাপ্য গুরুত্ব না দেওয়া সঙ্গত কি না, আদালতের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রাখিয়াও সেই প্রশ্ন তোলা যায়, তোলা কর্তব্য।
প্রশ্নটি অধিকার সংক্রান্ত। নির্বাচন আয়োজনের অধিকার। পঞ্চায়েত নির্বাচনের কর্মকাণ্ডটি কী ভাবে পরিচালিত হইবে, এই বিষয়ে কাহার অধিকার প্রধান এবং প্রবল— তাহা লইয়াই রাজ্য সরকার এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশনের মতানৈক্য। দুই তরফের বোঝাপড়ার সুবাদে ভোটপর্ব সম্পন্ন হইলে অচলাবস্থা কাটিতে পারে, কিন্তু অধিকার-প্রাধান্যের তর্কটির মীমাংসা হওয়া অত্যন্ত আবশ্যক ছিল। এই বিষয়ে বামফ্রন্ট সরকার আমলে প্রণীত রাজ্যের আইনটি সমস্যাসঙ্কুল এবং অংশত আপত্তিকর বলিয়াই সেই প্রয়োজন আরও বেশি। ওই আইনে পঞ্চায়েত নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে নিরঙ্কুশ অধিকার দেওয়া হয় নাই, রাজ্য সরকারের অধিকারও স্বীকার করা হইয়াছে। সমস্যা সেখানেই। সমস্যা যুগপৎ নীতিগত এবং আইনগত। প্রথমত, নির্বাচন একটি রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ভারতে উহা ভয়ানক ভাবে দলীয় রাজনীতির প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ইহা দুর্ভাগ্যজনক সত্য। আরও দুর্ভাগ্যজনক সত্য ইহাই যে, এই দেশে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে সরকার ভয়ানক ভাবে দলের বশীভূত। চৌত্রিশ বছরের সেই দলতন্ত্র দুই বছর যাবৎ সমানে চলিতেছে। ফলে, নির্বাচন আয়োজনে ও পরিচালনায় একটি যথার্থ নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব অত্যাবশ্যক। বস্তুত, রাজ্য বা কেন্দ্র স্তরের কোনও সরকার যদি দলের বশীভূত না-ও হয়, তথাপি নিরপেক্ষতার স্বার্থে নীতি হিসাবেই নির্বাচনের দায়দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের হাতে থাকাই বিধেয়। গণতন্ত্রের স্বার্থেই বিধেয়। গণতান্ত্রিক নির্বাচন কেবল নিয়মিত হওয়াই যথেষ্ট নয়, নিয়মানুগ হওয়াও আবশ্যক।
দ্বিতীয়ত, পঞ্চায়েত নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ ক্ষমতা অর্পণ না করিয়া রাজ্য সরকারের যে ভূমিকা রাখা হইতেছে, তাহা কি সংবিধানের নির্দেশ তথা সুপ্রিম কোর্টের অভিমতের পরিপন্থী নহে? ইতিপূর্বে স্থানীয় স্তরের একাধিক নির্বাচন সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্ট যে সব রায় দিয়াছেন, তাহাতে কিন্তু এই নীতিই প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে যে, নির্বাচন কমিশন যে স্তরেরই হউক, সংশ্লিষ্ট নির্বাচনের বন্দোবস্তটি সম্পূর্ণত তাহার এক্তিয়ারে, এ ক্ষেত্রে জাতীয় কমিশনের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বই আদর্শ। এই রায়গুলির পরিপ্রেক্ষিতে এমন ধারণা অযৌক্তিক নহে যে, পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনের ব্যবস্থাপনার সম্পূর্ণ অধিকার কমিশনেরই প্রাপ্য ছিল। হাইকোর্টের নির্দেশ কার্যত তাহার বিপরীত। আরও বড় কথা, হাইকোর্ট মূল সাংবিধানিকতার প্রশ্নটি কার্যত বিবেচনার বাহিরে রাখিয়া দিয়াছে। পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচন সংক্রান্ত আইনের ৪২ নম্বর ধারাটিতে রাজ্য সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের আপেক্ষিক এক্তিয়ার লইয়া যে আপাত-অস্বচ্ছতা রহিয়াছে, সংবিধান এবং সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মাপকাঠিতে তাহার নিরসন হওয়া একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরি ছিল। পঞ্চায়েত নির্বাচনের জন্য তো বটেই, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির স্বাধীনতার বৃহত্তর প্রেক্ষিতেও। নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা কেবল আদর্শগত কারণে নয়, দলতান্ত্রিক রাজনীতি ও প্রশাসনের বাস্তবতার কারণেও বিশেষ আবশ্যক। হাইকোর্ট যদি দ্রুত নির্বাচন সম্ভব করিয়া তোলার বাস্তব প্রয়োজনটিকে গুরুত্ব দিয়া থাকেন, নিরপেক্ষ নির্বাচনের দীর্ঘমেয়াদি নিশ্চয়তা সরবরাহের বাস্তব প্রয়োজনটিকেও গুরুত্ব দেওয়া কাম্য ছিল না কি? |
|
|
|
|
|