পার্ক স্ট্রিটে ট্রাফিক আইন ভেঙে পুলিশের হাতে পড়েছিলেন পরিবহণ দফতরের এক অফিসার। জরিমানার জন্য ট্রাফিক পুলিশের দেওয়া রসিদে চোখ রাখতেই খটকা লাগল তাঁর।
ছাপা রসিদে (কম্পাউন্ড স্লিপ) পুলিশ বিভাগের নামের পরিবর্তে লেখা রয়েছে ‘মোটর ভেহিকেল্স ডিপার্টমেন্ট’-এর নাম। অর্থাৎ, ওই অফিসারের দেওয়া জরিমানার টাকা গ্রহণ করছে মোটরযান বিভাগ।
এ বিষয়ে বিস্তারিত খোঁজ নিয়ে ওই অফিসার যে তথ্য জানতে পারলেন, তাতে ধন্দ আরও বাড়ল। তাঁর বয়ানে, “শুধু মোটর ভেহিকেল্স বিভাগের নাম লেখা স্লিপই নয়, কখনও তাতে লেখা থাকছে ‘অফিস অফ দ্য ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট/এসডিও’। কখনও বা থাকছে ‘ট্রান্সপোর্ট ডিপার্টমেন্ট’-এর নাম।” অথচ ওই স্লিপে নাম থাকার কথা পুলিশ বিভাগের। তিনি আরও জানান, জরিমানা আদায়ের কাগজের আকার-প্রকৃতিও মাঝেমধ্যেই বদলে যাচ্ছে। কখনও সাদা ছোট কাগজ, কখনও বড় আকারের কাগজ। পার্থক্য থাকছে রঙেও। ওই অফিসারের অভিযোগ, “অন্য দফতরের নাম ছাপানো নথি দিয়েই এখন জরিমানা বাবদ বছরে কোটি কোটি টাকা তুলছে পুলিশ।”
আর মূল প্রশ্নটা এখানেই। ট্রাফিক বিভাগের সূত্রের হিসেবে, কলকাতা পুলিশের সার্জেন্ট-পিছু গড়ে জরিমানা আদায় হয় দৈনিক তিন হাজার টাকা। মোট সার্জেন্টের সংখ্যা ৪০০-র কাছাকাছি। অর্থাৎ, দিনে ন্যূনতম সংগ্রহ ১২ লক্ষ টাকা। মাসে ৩.৬ কোটি। এ হিসেবে বছরে আদায় হওয়া উচিত ৪০-৪৫ কোটি টাকার মতো। কিন্তু ট্রাফিক বিভাগের হিসেবই বলছে, এর অনেক কম জমা পড়ে সরকারের ঘরে। সংশয়, আশঙ্কা, সন্দেহ এবং প্রশ্ন এই বিপুল পরিমাণ অর্থকে ঘিরেই। যদিও এ ব্যাপারে ডিসি (ট্রাফিক) দিলীপ আদকের জোরালো দাবি, “জরিমানার টাকা পুলিশ নিচ্ছে না। সব যাচ্ছে সরকারের কাছেই। হিসেব দেওয়া হচ্ছে সেখানেই।” |
সেখানেই থামছে না প্রশ্ন। অন্য দফতরের নাম লেখা রসিদে তোলা টাকা কোন দফতরের খাতে কতটা পাঠানো হচ্ছে, তাতেও সংশয় উঠছে খোদ লালবাজারের অন্দরে। কলকাতা পুলিশ রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতরের অধীনে। প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কী করে মোটরযান বিভাগের নাম ছাপানো কাগজে পুলিশ জরিমানা আদায় করছে? অন্য দফতরের নাম ছাপানো কাগজে জরিমানা নেওয়ায় সরকারি হিসাবে বিস্তর গরমিল ও দুর্নীতির গন্ধ পাচ্ছেন সরকারি কর্তাদেরই একাংশ। স্বরাষ্ট্র দফতরের অধীন কলকাতা পুলিশের ‘অডিট’-এ অন্য দফতরের নাম ছাপানো কাগজ পেশ করা যায় কি না, প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও।
লালবাজারের ট্রাফিক বিভাগের প্রাক্তন কর্তাদের অনেকে আবার প্রশ্ন তুলেছেন এই ধরনের স্লিপের বৈধতা নিয়ে। তাঁদেরই এক জনের বক্তব্য, “সরকারি কোনও কাগজে যে দফতরের নাম ছাপানো থাকে, সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মীরই তা ব্যবহার করার অধিকার রয়েছে। অন্য কোনও দফতর ওই নথি ব্যবহার করতে পারে না।” তা হলে কে ছাপাল ওই রসিদ? পরিবহণ দফতরের সহকারী সচিব তথা আলিপুরের ‘রিজিওন্যাল ট্রান্সপোর্ট অফিসার’ (আরটিও) চপল বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “পরিবহণ দফতর ওই নথি ছাপায়নি এটুকু বলতে পারি। কম্পাউন্ড স্লিপে জরিমানা আদায়ের কিছু অধিকার পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে জরিমানা আদায়ের নথিতে পুলিশ বিভাগেরই নাম থাকা উচিত।”
কলকাতা পুলিশের ডিসি (ট্রাফিক) অবশ্য বলেন, “মোটরযান আইন মেনেই এই স্লিপ ছাপিয়েছে পুলিশ। এ ভাবে জরিমানা আদায় আইনবিরুদ্ধ হলে তো পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা হত! বহু দিন ধরে তো এ ভাবেই চলছে। কবে, কী কারণে এ রকম নথি ছাপা হল, তা পুরনো ফাইল ঘেঁটে দেখা হচ্ছে।” তবে একই সঙ্গে তিনি জানিয়ে দেন, এই সংশয় কাটাতে দ্রুত কলকাতার পুলিশ কমিশনারের নামে কম্পাউন্ড স্লিপ ছাপানোর কথা পরিবহণ দফতরকে জানানো হবে। লালবাজার সূত্রের খবর, ওই স্লিপ ছাপার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে।
বর্তমান ট্রাফিককর্তার দাবির সঙ্গে একমত নন ট্রাফিক বিভাগেরই প্রাক্তন এক উচ্চপদস্থ কর্তা। তিনি বলেন, “এ ধরনের কাগজ আগে কখনও দেখিনি। এ রকম হওয়া উচিতও নয়।”
ট্রাফিক বিভাগ সূত্রের খবর, আগে ‘ডেপুটি কমিশনার অফ পুলিশ, ট্রাফিক ডিপার্টমেন্ট’ ছাপা কাগজে শহরজুড়ে জরিমানা আদায় করা হত। ২০১১ সালের শেষ দিকে জরিমানা আদায়ের রীতি-নিয়মে পরিবর্তন হয়। অভিযোগ, তখন থেকেই মোটরযান বিভাগের ‘কম্পাউন্ড স্লিপ’-এর আদলে ছাপা কাগজে জরিমানা আদায় করতে শুরু করে পুলিশ। ট্রাফিকের এক অফিসারের কথায়, “সাধারণ কোনও পুলিশকর্মীর কাছে ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা নেই। তাঁরা চাইলেই কারও কাছ থেকে জরিমানা নিতে পারেন না। কলকাতার পুলিশ কমিশনার ‘এগজিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট’ পদমর্যাদার। তিনি ডিসি (ট্রাফিক)-কে জরিমানা আদায়ের ক্ষমতা দিয়েছেন। ট্রাফিককর্তার ওই ক্ষমতার সাহায্যেই সার্জেন্টরা মামলা করতে পারেন। সে কারণে জরিমানা আদায়ের নথিতে পুলিশ কমিশনার বা ডিসি (ট্রাফিক)-এর নাম থাকা বাঞ্চনীয়। না হলে কোন ক্ষমতায় সার্জেন্টরা জরিমানা নিচ্ছেন, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হতে পারে।”
আপাতত ‘সংশয়ের রসিদেই’ জরিমানা গুণতে হচ্ছে শহরবাসীকে। |