সাধের ডায়েরিটাই কাল হল সুমন সাহার। কে জানত, বৌ কখন ডায়েরির প্রথম পাতায় গোটা গোটা অক্ষরে তার নাম, ঠিকানা এমনকী মোবাইল নম্বরও লিখে রেখেছে! এই ডায়েরির সূত্র ধরেই চুরির অভিযোগে গ্রেফতার করা হল তাকে।
কোনও রকমে গয়নার পোঁটলাটা নিয়ে সেই পাঁচতলা থেকে চার-চারটে ধাপ এক-এক বারে লাফিয়ে রাস্তায় নেমে পাক্কা তিন কিলোমিটার দৌড়েছিল সে। সোনার গয়নাগুলি হাতে নিয়ে প্রথমেই মনে হয়েছিল বৌয়ের কথা। বিয়েতে সোনার কিছু দিতে পারেনি। কারণ, বিয়ের আগের রাতে যে চুরিটা করেছিল তাতে পাওয়া কিছু নগদ টাকায় নমো নমো করে হলেও বিয়ের খরচটাই ওঠেনি। সংসারে টানাপোড়েন, নিত্যদিন বৌয়ের খিটিরমিটির। এ দিকে, চিমনি কোম্পানির চাকরিটাও গিয়েছে। কিন্তু পুরনো অভ্যাসে ডায়েরিটা নিয়েই বেরোত সে। নিজেকে চিমনি কোম্পানির এজেন্ট বলে পরিচয় দিয়ে গৃহস্থের হেঁশেলে ঢুকত। চোখ অবশ্য ঘুরত গোটা বাড়িতে। রান্নাঘরে কোথায় চিমনি বসবে আর কোন দিক দিয়ে তার ধোঁয়া বেরোলে সুবিধা হবে, তা বুঝে নেওয়ার অছিলায় গোটা বাড়িতেই এক বার চক্কর দিয়ে নিত সে। দুপুর বা বিকেলের দিকে সাধারণত মহিলারা একাই বাড়িতে থাকেন। খাওয়ার জল আনানো বা যে বাড়িতে চিমনি আছে, তা পরিষ্কারের জন্য কোনও কিছু আনার কথা বলে গৃহকর্ত্রীর সামান্য সময়ের অন্যমনস্কতার সুযোগেই হাত সাফাই করে ফেলত সুমন। দমদম থেকে বারাসত বা ইছাপুর থেকে উত্তরপাড়া, সর্বত্রই রাস্তাঘাট মোটামুটি তার নখদর্পণে। |
গত ৩ মে দুপুরে ব্যারাকপুর তালপুকুরে একটি বহুতলের পাঁচতলায় প্রাক্তন নৌবাহিনী অফিসার সুভাষ বিশ্বাসের ফ্ল্যাটে কড়া নেড়েছিল সুমন। দুপুরে ভাতঘুম দিচ্ছিলেন প্রৌঢ় দম্পতি। সদর দরজা ছিল ভেজানো। এত সহজে ভিতরে ঢুকতে পেরে চুরির নেশাটা মাথায় ঢুকে গিয়েছিল তার। দুই ঘরে দু’জনকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে তৃতীয় ঘরে সটান আলমারির সামনে হাজির হয়ে হাতল টানতেই খুলে গিয়েছিল স্টিলের আলমারির পাল্লা। হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো আনন্দে বিছানায় এক বার গড়াগড়িও খেয়ে নিয়েছিল সুমন। হাতের ডায়েরিটা বিছানার এক পাশে রেখে আলমারি থেকে গয়না বার করে সবে যখন চাদর বিছিয়েছে, তখনই পাশের ঘরে ঘুম ভেঙে যায় সুভাষবাবুর স্ত্রী সোমাদেবীর। আওয়াজ শুনে দরজার কাছে এসে দেখেন সুমন একমনে গয়না গুনছে। চোর চোর বলে চিৎকার জুড়তেই কোনও রকমে পোঁটলা নিয়ে দৌড়ে লাফিয়ে সিঁড়ি টপকে নেমে দে ছুট। তখন তার কাছে হার মানেন পি টি ঊষাও। এর পরে সোজা টিটাগড় বাজার পেরিয়ে একটা লস্যির দোকানে ঢুকে দু’গ্লাস লস্যিও খেয়েছিল তেষ্টা মেটাতে। বাড়ি ফিরেও সময় নষ্ট করেনি সে। বিরাটির এক সোনার দোকানে গয়নাগুলি গলাতে দিয়েছিল। নতুন ডিজাইনের হাল ফ্যাশনের একটি গয়না ও নগদ টাকা নেওয়ার বিষয়ে দোকানমালিক বিশ্বজিৎ মালাকারের সঙ্গে দরদামও পাকা হয়ে গিয়েছিল।
এত ক্ষণ সব ঠিকঠাক চলছিল। বাদ সাধল ডায়েরিটা। টিটাগড় থানার পুলিশ ওই কালো ডায়েরির প্রথম পাতায় সুমনের নাম ও নিমতার বিশরপাড়ায় তার ঠিকানা দেখে ১২ মে, রবিবার হাজির হয় তার বাড়িতেই। বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে ডায়েরিতে লেখা ফোন নম্বর দেখে তদন্তকারী অফিসার তাকে ফোন করেন। চিমনি সারানো নিয়ে কথাবার্তার পরে সোজা বাড়িতে হাজির হয়ে হাতেনাতে ধরা হয় তাকে। ততক্ষণে পালিয়েছে সুমনের বৌ। সুমনকে জেরা করে সোমবার ধরা হয়েছে সোনার দোকানিকেও। ব্যারাকপুরের এডিসি শুভঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘প্রায় ৪৫ গ্রাম সোনার গয়না চুরি যায়। সবটাই উদ্ধার হয়েছে।’’ |