জাল নম্বর, জাল ইঞ্জিন, জাল কাঠামো (শ্যাসি) কলিকাতার অলিতে-গলিতে যে অগণিত অটো রিকশ নিত্য কালো ধোঁয়া উড়াইয়া সওয়ারি বহন করে, তাহাদের এক বিপুল অংশই ‘জাল অটো’। মহানগরীতে এই জালিয়াতি যদি গলিপথে সীমাবদ্ধ, তাহার উপকণ্ঠে তবে ইহা ব্যাপক। ভুয়া নম্বরপ্লেট ও জাল ইঞ্জিনের এই অটোর বহুলপ্রচলন কর্তৃপক্ষ সহসা আবিষ্কার করিলেন, ইহাই বিস্ময়কর। মুরারিপুকুর এলাকার গলিঘুঁজিতে যাতায়াতকারী কিছু অটোর উপর নজরদারির ফলেই নাকি পুলিশ এই জালিয়াতি উদ্ঘাটন করিয়াছে। ইহা হিমশৈলের চূড়া মাত্র। মনে করিবার কারণ আছে যে, পুলিশ তাহা জানে, পরিবহণ কর্তারা জানেন, খোদ পরিবহণমন্ত্রীও বিলক্ষণ জানেন কলিকাতায় ত্রিশ হাজার বেআইনি অটোর সংখ্যা তাঁহারই দেওয়া। তবু তাহারা চলিতেছে, চলিবে।
ইদানীং গ্রামগঞ্জ ও মফস্সলের পাকা সড়কে যাতায়াতকারী এবং ক্রমশ শহরগুলিতেও অনুপ্রবেশকারী ইঞ্জিন-লাগানো ভ্যান-রিক্শ রাজ্য ছাইয়া ফেলিতেছে। এ ভাবে ইঞ্জিন লাগানো কেবল বেআইনিই নয়, ‘কাটা-তেল’-এ চলা এই যানগুলি ভয়ঙ্কর পরিবেশদূষকও বটে। অদ্যাবধি এগুলিকে নিয়ন্ত্রণ বা নিষিদ্ধ করার কোনও যথাযথ উদ্যোগ দেখা যায় নাই। উপরন্তু দলীয় নিশান উড়াইয়া এই ‘বকচ্ছপ’ যানগুলি রাজ্য দাপাইতেছে। সম্প্রতি কলিকাতার প্রাণকেন্দ্রে বেশ কয়েক হাজার এই যানের চালককে লইয়া ফরওয়ার্ড ব্লক লাইসেন্সের দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শনও করিয়াছে। অর্থাত্ সেই বেআইনিকে আইনসিদ্ধ করার চাপ। যে-শহরে পুরসভা বেআইনি বাড়িকে আইনসিদ্ধ করিতে জরিমানা লয়, সেখানে বেআইনি যানকে লাইসেন্স দেওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ হইবে, ইহা আর আশ্চর্য কী? হয়তো ফরওয়ার্ড ব্লক বিরোধী দল বলিয়া সরকার এখনই তাহার দাবি শিরোধার্য করিবে না, হয়তো বা যান-চালকদের ইউনিয়ন নেতৃত্ব রাজনৈতিক আনুগত্য শাসক দলের প্রতি স্থানান্তরিত করিলে তখন ‘সহানুভূতির সহিত’ তাঁহাদের দাবিটি বিবেচিত হইবে।
রাজ্যের পরিবহণ চিত্রটির দিকে তাকাইলে স্পষ্ট, আইনের শাসনের কোনও বালাই এখানে নাই। পনেরো বছরের পুরানো বাণিজ্যিক গাড়িকে বায়ুদূষণের দায়ে বরবাদ করার হাইকোর্টের নির্দেশটি বহাল আছে, কিন্তু বিষবাষ্পে শহরের শ্বাস রুদ্ধ হইয়া আসিতেছে। অটোর দৌরাত্ম্য হইতে শহরবাসীকে রক্ষা করিতে তাহাতে মিটার লাগানো এবং ভাড়া বাঁধিয়া দেওয়ার জন্য প্রদত্ত আদালতের নির্দেশও পরিবহণ মন্ত্রক মানিতেছে না, পুনর্বিবেচনার আর্জি জানাইতেছে। অনুমান করা সহজ, কায়েমি স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়া সরকার নীতি ও আইনের পথ পরিহার করিতেছে। শাসক দলের রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণই যেন শেষ কথা। রাজ্যবাসীর বৃহত্তর ও দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়া রাজনৈতিক দলের ধ্বজাধারী গোষ্ঠীর সংকীর্ণ ও তাত্ক্ষণিক স্বার্থ সিদ্ধ করাই যেন শাসননীতি। রাজ্যকে ইহার কুফল ভোগ করিতে হইতেছে। তাহাই রাজ্যবাসীর নিয়তি। |