মাদুর শিল্পের উন্নয়নে নানা সময়ে নানা প্রকল্পের কথা শোনা গিয়েছে। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে, মাদুর শিল্পীরা থেকে গিয়েছেন তিমিরেই। তাঁরা প্রথাগত পদ্ধতির বাইরে বেরোতে পারেননি। পণ্য বাজারজাত করতেও শিল্পীদের ভরসা ফোঁড়েরা। এই পরিস্থিতিতে নতুন প্রজন্ম আর এই শিল্পে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। পূর্বপুরুষদের পেশা বদলাচ্ছেন অনেকেই।
পশ্চিম মেদিনীপুরের সবং এই শিল্পের প্রাণকেন্দ্র। এই পরিস্থিতির জন্য রাজ্য সরকারের উদাসীনতাকেই দায়ী করেছেন স্থানীয় কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়া। তাঁর বক্তব্য, “মাদুর শিল্পের উন্নয়নে অনেক লড়াই করেছি। বাম সরকারও শিল্পের আধুনিকীকরণে উদ্যোগী হয়নি। বর্তমান সরকারও তেমন উদ্যোগী নয়। ন্যাচরাল ফাইবার মিশনে টাকা এসেও পড়ে রয়েছে। কিন্তু কাজ এগোচ্ছে না।” অতিরিক্ত জেলাশাসক (উন্নয়ন) সুমন ঘোষ অবশ্য বলেন, “ন্যাচরাল ফাইবার মিশনের মাধ্যমে শিল্পের আধুনিকীকরণ করার জন্য চার স্তরীয় প্রকল্প গ্রহণ করেছে সরকার। তা বাস্তবায়িত করতে পদক্ষেপও শুরু হয়েছে।”
মাদুর শিল্পের উন্নয়নে বিশেষ কেন্দ্রীয় প্রকল্পেও অর্থ পেয়েছিল পশ্চিম মেদিনীপুর। মাদুর শিল্পীদের আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও তাঁদের তৈরি মাদুর যাতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এমনকী বিদেশেও রফতানি করা যায়, তারও পরিকল্পনা ছিল। প্রয়োজনীয় টাকা এসেছিল ২০০৭-০৮ অর্থবর্ষে। কিন্তু জমি-বিতর্কে সেই প্রকল্প বাস্তবায়িত করা যায়নি। রুইনানের বিতর্কিত জমিতে প্রায় ৬০ লক্ষ টাকা খরচ করে কেবল মাটি ভরাট করা হয়েছিল। প্রকল্প বাস্তবায়িত না হয়নি। আদৌ কোনও দিন বাস্তবায়িত হবে কিনা, সংশয় রয়েছে। |
মাদুর বুনতে ব্যস্ত বাড়ির মহিলারা। সবংয়ের গ্রামে। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ। |
এ বার কেন্দ্রীয় প্রকল্প ‘ন্যাচরাল ফাইবার মিশনে’ শিল্পোন্নয়নের তোড়জোর শুরু হয়েছে। ৫ বছরে ১৪ হাজার শিল্পীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা এই প্রকল্পে। এর আওতায় মাদুর ছাড়াও বাঁশ, সাবাই ঘাস ও তাঁত শিল্পও রয়েছে। তবে সব থেকে গুরুত্ব পাচ্ছে মাদুর শিল্প। ১৪ হাজারের মধ্যে ৯ হাজার ৭০০ জনই মাদুর শিল্পী। গত বছর শুরু হয়েছে কাজ। এখনও পর্যন্ত ৮২০ জন মাদুর শিল্পীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। চারটি স্তরে হবে প্রশিক্ষণ। প্রথমে গ্রামীণ স্তরে, তারপর পঞ্চায়েত স্তরে। এই স্তরে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও গড়া হবে। পঞ্চায়েত স্তরে প্রশিক্ষণের পর শিল্পীরা আবেদন জানালে ব্লক স্তরের কমিটি তা মঞ্জুর করবে। ব্লক স্তরেও কমিউনিটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরি হবে। সর্বশেষ স্তরে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি হবে খড়্গপুর বিদ্যাসাগর ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে। তার জন্য ২৫ একর জমি নেওয়া হয়েছে। কিন্তু পঞ্চায়েত বা ব্লক স্তরে জমি চিহ্নিতকরণের কাজই হয়নি। অতিরিক্ত জেলাশাসক (উন্নয়ন) বলেন, “জমি চিহ্নিত করণের কাজ শুরু হয়েছে। জমি পেলেই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরির কাজ শুরু করে দেব। এক্ষেত্রে টাকা কোনও সমস্যা হবে না।”
সরকারি এই উদ্যোগ এখনও জানেন না সাধারণ মাদুর শিল্পীরা। পরশুরামপুর, বাগবেড়িয়া, ভাঙাবাড়ি, বলরামপুরের মাদুর শিল্পীদের কথায়, “এরকম কোনও প্রকল্পের কথা তো আমাদের জানা নেই। মাঝে মধ্যেই শুনি এটা হচ্ছে, সেটা হচ্ছে, আমরা তার কোনও সূযোগও পাই না।” তাই তাঁরা প্রথাগত ভাবেই মাদুর তৈরি করে চলেছেন আপন মনে। ৪৫ ইঞ্চির দু’টি মাদুর সবংয়ের বাজারে ফোঁড়েদের বিক্রি করে ৩৬০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত পান। যার জন্য মাদুর কাঠি লাগে ১৭০ টাকার, ১৬ টাকার সুতলি দড়ি। তার সঙ্গে ২ দিনের মজুরি যোগ করলে ক্ষতিই হয়। মঞ্জু বেরা, সুপ্রভা বেরাদের কথায়, “রান্নাবান্না শেষে বাড়িতে বসে থাকব কেন, তাই মাদুর তৈরি করি। যা হয় তাই বা কম কী।” অজিত বেরার কথায়, “এখন বিক্রির ব্যাপারে একটা অতিরিক্ত সুযোগ এসেছে। বাজারে অনেক ফোঁড়ে আসে। এক ফোঁড়ে দাম খুব কম বললে অন্য ফোঁড়ের কাছে যায়। তবু দামটা কিছুটা বেশি মেলে। আগে তো হাতে গোনা ফোঁড়ে ছিল। যা দাম ঠিক করত তাতেই বেচতে হত। হাতের কাজ জানি বসে তো থাকতে পারি না। যা নুন, তেলের খরচ ওঠে তাই লাভ।”
সবংয়ে আড়াই লক্ষেরও বেশি মানুষের বসবাস। যার মধ্যে ৭৫ হাজারের বেশি মানুষ এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। শিল্পীদের প্রশ্ন, তাঁদের জন্য কী সরকার কোনওদিন ভাববে না?
প্রশাসন জানিয়েছে, প্রথাগত শিল্প থাক। তার সঙ্গে আধুনিক শিল্পেও প্রশিক্ষিত হন শিল্পীরা। সেই লক্ষ্যেই ন্যাচারাল ফাইবার মিশন। কিন্তু সেই লক্ষ্য পূরণ হবে তো? টাকা পড়ে থাকলেও কাজ যে এগোচ্ছে না। ফলে, ভুক্তভোগী মাদুর শিল্পীরা ভরসা পাচ্ছেন না। নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়েই তারা জানেন, শুধু প্রতিশ্রুতিতে পেট ভরে না, বাপ-ঠাকুরদার পেশাও বাঁচানো যায় না। |