পাকিস্তানের নির্বাচনের ফল স্পষ্ট হওয়ামাত্রই নয়াদিল্লির টেলিফোন পৌঁছাইল জয়ী নেতা নওয়াজ শরিফের নিকট। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনী ফলাফলে বিশেষ প্রীতি ও দুই দেশের শান্তি প্রক্রিয়ায় বিশেষ অগ্রগতির আশা প্রকাশ করিলেন। ভারত ও পাকিস্তানের সাম্প্রতিক আস্থাহীনতা ও শান্তিহীনতার প্রেক্ষিতে এই আশাময় টেলিফোন নেহাত রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা বলিয়া প্রতীত হইবার কথা। কিন্তু বাস্তবিক, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বার্তার মধ্যে আনুষ্ঠানিকতার সহিত একটি বড় সত্যও উপস্থিত। ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ককে যদি এক দাগও উন্নত করিতে হয়, তবে পাকিস্তানের নব্বই দশকের দুই দফার প্রধানমন্ত্রী, বর্তমান পাকিস্তান মুসলিম লিগ দলের নেতা নওয়াজ শরিফই একমাত্র আশা। সব বড় মাপের পাক নেতাই হয়তো জানেন যে ভারতের সহিত বিবাদ বাড়াইয়া পাকিস্তানের লাভ নাই। কিন্তু একমাত্র নওয়াজ শরিফের পক্ষেই এই বিবাদ-হ্রাসের লক্ষ্যে প্রয়াসী হওয়া সম্ভব। তাহার কারণ এই নহে যে শরিফ উদারমনস্ক নেতা। ঠিক উল্টা। তাহার কারণ, শরিফের প্রধান পরিচয়, তিনি দক্ষিণপন্থী, রক্ষণশীল পঞ্জাবি জাতীয়তাবাদী, ইসলামি মৌলবাদী শিবিরেরও অত্যন্ত আস্থাভাজন নেতা। তাঁহার আমলেই পাকিস্তান পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষা করিয়া ভারতকে চাপে ফেলিয়াছিল। তালিবানি আঘাত তালিকায় একমাত্র তাঁহার দলেরই নাম নাই, কেননা তিনি কখনওই তালিবান বা মৌলবাদকে আক্রমণের লক্ষ্য করেন না। অন্য কোনও নেতা ভারত-মিত্রতার কথা বলিলে পাক সমাজে তাঁহাকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা শুনিতে হইত। কিন্তু এমন কট্টর পঞ্জাবি রক্ষণশীলতার ঘরানা হইতেও যদি কোনও নেতা ভারত-মিত্রতার বার্তা দেন, তাঁহার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উঠিবার শঙ্কা কম, ফলত, তাঁহার সাফল্যের পথ তুলনায় প্রশস্ত।
নির্বাচনী ফলাফল বলিতেছে, অন্য কোনও দলের সহায়তা ব্যতীতই নওয়াজ শরিফ রাষ্ট্রক্ষমতার রাশ হাতে রাখিতে পারিবেন। সে ক্ষেত্রে তাঁহার এই প্রবল পঞ্জাবি পরিচয় সংকট তৈয়ারি করিতে পারে। পাক রাষ্ট্রচালনার ক্ষেত্রে প্রকট পঞ্জাব-কেন্দ্রিকতা লইয়া অন্যান্য প্রদেশে সর্বদাই অভিযোগ। সেই প্রাদেশিক বিক্ষোভ ও অশান্তির প্রতিফলন পড়িতে পারে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতেও। সেনাবাহিনীর সহিতও শরিফের সম্পর্ক নানা কারণে মন্দ। প্রাক্তন সেনাধ্যক্ষ ও উত্তরসূরি প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশারফের সহিত তাঁহার গভীর শত্রুতার সম্পর্ক: শরিফ মুশারফকে সামরিক শীর্ষপদ হইতে সরাইয়া দেন। বদলা হিসাবে, সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মুশারফ শরিফকে পদচ্যুত করেন ও দেশান্তরের অসম্মানস্বীকারে বাধ্য করেন। তাঁহার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও তোলা হয়। কিন্তু কেবল মুশারফই নহেন, বৃহত্তর অর্থেও পাক সামরিক বাহিনীর রাজনৈতিক সক্রিয়তা শরিফের ঘোর অপছন্দ। এই পুরাতন বিদ্বেষ ভুলিয়া শরিফের এ বার সতর্ক পদচারণা প্রয়োজন। আশার কথা, আগামী বৎসর জেনারেল কায়ানিরও সরিয়া যাইবার কথা। নূতন নেতার সহিত নূতন ভাবে কার্যকর সম্পর্ক গড়িয়া তোলা হইবে শরিফের অন্যতম গুরুদায়িত্ব।
তবে সর্বাপেক্ষা বড় দায়িত্বটি যে শরিফ ভোলেন নাই, তাহার প্রমাণ পিএমএল(এন)-এর বিজয়োৎসবের প্রধান ফোকাস ‘অর্থনীতি, অর্থনীতি ও অর্থনীতি’। প্রভূত পরিমাণ জাতীয় ঋণের বোঝা হালকা করা প্রয়োজন, তাহার জন্য প্রয়োজন বৃহৎ অঙ্কের অনুদান ও অর্থসহায়তা আনয়ন। এবং এই জন্য এখনই দরকার আর্থিক সংস্কারের সূচনা। পারিবারিক উত্তরাধিকারে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী নেতা নওয়াজ শরিফ ভাল ভাবেই জানেন, তাঁহার প্রবল জনসমর্থন-ভিত্তির অন্যতম কারণ তাঁহার অর্থনৈতিক বিচক্ষণতার প্রতি মানুষের আস্থা। এবং পরিকাঠামো নির্মাণে তাঁহার অভিজ্ঞতা। উৎসব-স্লোগানের ধারা শেষ হইলে, কী ভাবে এই প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা তিনি কার্যে রূপায়িত করেন, তাহার উপরে তাঁহার সাফল্য নির্ভর করিবে। কেবল পাকিস্তানের জন্য নহে, ভারত ও সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার জন্যই পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর এই সাফল্য বাঞ্ছিত। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত দ্বিতীয় পাক সরকারের স্থিতির উপর নির্ভর করিতেছে গোটা অঞ্চলের ভবিষ্যৎ। |