সুভাষচন্দ্রের সেই সভা মনে রাখেনি ঝাড়গ্রাম
সালটা ১৯৪০। শুরু হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। জাতীয় রাজনীতিতেও সে এক উথাল-পাথাল সময়। গাঁধী-সুভাষ মতবিরোধ স্পষ্ট। কংগ্রেসের সঙ্গেও সুভাষচন্দ্রের দূরত্ব প্রকট। ওই বছরই ১২ মে ঝাড়গ্রামে এক জনসভায় এসেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। অবিভক্ত সাবেক মেদিনীপুরে সেটিই ছিল তাঁর শেষ জনসভা। ঐতিহাসিক ওই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে আজ পর্যন্ত কোনও প্রশাসনিক উদ্যোগ চোখে পড়েনি। রবিবার নেতাজির পদার্পণের ৭৩তম বর্ষপূর্তির মুহূর্তটিও নীরবেই কেটে গেল।
অনাদরে পড়ে সেই স্মৃতিফলক। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।
তাৎপর্যপূর্ণ এই দিনটিতে সরকারি-বেসরকারি কোনও আয়োজনই ছিল না। গবেষক তথা প্রবীণ সাংবাদিক তারাপদ করের আক্ষেপ, “প্রশাসনিক ভাবে আজ পর্যন্ত সুভাষচন্দ্রের ঝাড়গ্রামে আগমনের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। সিংহভাগ ঝাড়গ্রামবাসী সুভাষচন্দ্রের ওই সভা সম্পর্কে জানেন না। এটা অত্যন্ত লজ্জার বিষয়।”
সুভাষচন্দ্র ঝাড়গ্রামে যেখানে সভা করেছিলেন, সেই ঐতিহাসিক ‘লালগড়ের মাঠ’ এখন দুর্গা ময়দান নামে পরিচিত। সেখানেই দৃপ্ত কণ্ঠে সুভাষচন্দ্র ঘোষণা করেছিলেন, ‘আপস নয়, সংগ্রাম ও ত্যাগের পথেই স্বরাজ আসবে’। তারপর বহু বছর কেটে গিয়েছে। পাল্টেছে শহরের চালচিত্র। সংকুচিত হয়েছে মাঠের আয়তন। সে দিনের সভায় যেখানে হাজার কুড়ি লোকের জমায়েত হয়েছিল, এখন সেখানে মেরেকেটে পাঁচশো লোকও ধরবে না। নব্বইয়ের দশকে এই এলাকায় সুপার মার্কেট তৈরি করা নিয়ে ‘দুর্গা ময়দান রক্ষা কমিটি’র সঙ্গে পুর-কর্তৃপক্ষের আইনি লড়াই এখনও চলছে। ইতিমধ্যে এখানে তৈরি হয়েছে স্থায়ী দুর্গামন্দির। ১৯৯৭ সালে সুভাষচন্দ্রের জন্মশতবর্ষে দুর্গা ময়দান রক্ষা কমিটির উদ্যোগে মাঠের একপাশে একটি স্মারকস্তম্ভ তৈরি করা হয়। সেই স্তম্ভের উদ্বোধন করেছিলেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রয়াত সুবোধচন্দ্র হাঁসদা। তাঁর ছেলে সুকুমার হাঁসদা বর্তমানে রাজ্যের মন্ত্রী। তা-সত্ত্বেও সুভাষচন্দ্রের ঝাড়গ্রাম আগমনের দিনটি স্মরণীয় করে রাখার কোনও উদ্যোগ গৃহীত হয়নি। সুকুমারবাবু মুখে অবশ্য বলছেন, “সুভাষ-স্মৃতি আমরা মলিন হতে দেব না।” আর ঝাড়গ্রামের সিপিএম পুরপ্রধান প্রদীপ সরকারের যুক্তি, “স্মৃতি বিজড়িত ওই মাঠটি পুরসভার হাতে নেই। মামলা চলায় এই মুহূর্তে কোনও পদক্ষেপ করা সম্ভব নয়।” দুর্গা ময়দান রক্ষা কমিটির অবশ্য দিনটি মনেই নেই।
এই আশ্বাস আর যুক্তির মাঝে পরে সুভাষ-স্মৃতি কিন্তু মুছে যেতে বসেছে। দুর্গা ময়দানের স্মৃতি-ফলকটিতেও রয়েছে ভুল তথ্য। সেখানে লেখা আছে, পরাধীন ভারতবর্ষে সুভাষচন্দ্রের শেষ জনসভাটি দুর্গা ময়দানে হয়েছিল। অথচ গবেষক তারাপদবাবুর মতে, “ঝাড়গ্রামের সভাটি ভারতবর্ষে সুভাষচন্দ্রের শেষ জনসভা নয়। ১৯৪০ সালের মে মাসে আরও ৮টি সভা করেছিলেন তিনি। হিসেবমতো ঢাকার করোনেশন পার্কের সভাটি সম্ভবত সুভাষচন্দ্রের শেষ জনসভা।”
সুভাষচন্দ্র যখন এসেছিলেন, তখন কিন্তু উৎসাহ-উদ্দীপনার অন্ত ছিল না। ১৯৪০ সালের ১৪ মে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, ঝাড়গ্রামে সভার আগের দিন অর্থাৎ ১১ মে, শনিবার কলকাতা থেকে ট্রেনে মেদিনীপুরে এসেছিলেন সুভাষচন্দ্র। নাড়াজোল রাজের অতিথি হয়ে গোপপ্রাসাদে রাত কাটান তিনি। ১২ মে, রবিবার সকালে ধেড়ুয়া হয়ে মোটরগাড়িতে ঝাড়গ্রাম আসেন। দহিজুড়িতে সুভাষচন্দ্রকে অভ্যর্থনা জানাতে বিশাল তোরণ বানানো হয়েছিল। কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের তীব্র মতবিরোধ সত্ত্বেও কংগ্রেস কর্মীরাই তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন কৃষক ও যুবকেরা। ঝাড়গ্রামে ব্যবসায়ী নলিনবিহারী মল্লিকের আতিথ্য গ্রহণ করে একটি টালির বাড়িতে বিশ্রাম নেন সুভাষচন্দ্র। দুপুরে নতুনডিহিতে কর্মী সম্মেলন করেন। তারপর বার-লাইব্রেরিতে আইজীবীদের সঙ্গে মিলিত হন। বিকেলে জনসভায় বক্তব্য রাখেন। ওই সভার উদ্যোক্তা ছিলেন নাড়াজোল রাজ এস্টেটের কুমার দেবেন্দ্রলাল খান।
সুভাষচন্দ্রের ওই সভায় শ্রোতা হিসেবে হাজির হয়েছিলেন ধোবাধোবিন গ্রামের বাসিন্দা সুধাকর মাহাতো। তখন তিনি নিতান্তই বালক। অশীতিপর বৃদ্ধ সুধাকরবাবুর কথায়, “তখন আমার বয়স মাত্র এগারো। সভা শেষে সুভাষচন্দ্র ঝাড়গ্রাম স্টেশন থেকে রাতের ট্রেনে ফিরে গিয়েছিলেন। শুধু মনে আছে, সে দিন তাঁকে দেখতে মানুষের ঢল নেমেছিল।” এ দিন অবশ্য বিস্মৃতির অন্তরালেই থেকে গেলেন সুভাষচন্দ্র।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.