সম্পাদক সমীপেষু...
আজও সেই পুজো হয়
উজ্জ্বল উদ্ধারকে আনন্দ স্বীকৃতি’ (২৮-৪) শীর্ষক প্রতিবেদনে গৌতম চক্রবর্তী কমলেকামিনী পূজা সম্পর্কে লিখেছেন, “সেই পুজো আর নেই। কখনও কখনও দেবদেবীরাও বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যান”। সবিনয় জানাই, এই পুজো এখনও আছে মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর শহরের মটুরাপাড়া লেনে। বর্তমানের স্থায়ী মণ্ডপটি ১৩৭১ বঙ্গাব্দে নির্মিত হলেও এই পুজোর বয়স প্রায় দেড়শো বছর বা তারও বেশি। পুজোটি বারোয়ারি। প্রতি বছর জামাইষষ্ঠীর দিন পুজো আরম্ভ, শেষ হয় দশমীতে। দেবী দুই হাতে দুটো হাতির শুঁড় ধরে রয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে বর্ণিত দেবীর হাতি গিলে উগরে দেওয়ার চিন্ময়ী রূপটি মৃন্ময়ী মূর্তিতে এই ভাবে রূপায়িত। দেবী ত্রিনয়না, স্বর্ণবর্ণা, রক্তবস্ত্রাবৃতা, এক পায়ের উপর অপর পা রেখে পদ্মে সমাসীনা। দুই পাশে তাঁর দু’জন সহচরী জয়া এবং বিজয়া। প্রতিমার চালচিত্র সাদা-লাল-সবুজ কাগজে তৈরি একশো আটটি পদ্ম দ্বারা শোভিত। এও যেন কাব্যবর্ণিত এক পদ্মবন।
এ বার দেখা যাক দেবীর কাব্যবর্ণিত রূপ। সুকুমার সেন সম্পাদিত ‘কবিকঙ্কণ মুকুন্দ বিরচিত চণ্ডীমঙ্গল’-এ আছে “ধরি রামা বাম করে সংহারয়ে করিবরে উগারিয়া করএ সংহার।/...বদন ঈষত মেলে কুঞ্জর উগারে গিলে/ জাগরণে সপন প্রকার।” (করিবর= কুঞ্জর= হাতি)। পুজোতে প্রতি দিন দেবীকে লুুচি-সুজি-নানা ব্যঞ্জন নিবেদন করা হয়। ভোগের বিশেষ বৈশিষ্ট্যরূপে সপ্তমী-অষ্টমী-নবমীতে যথাক্রমে সাত, আট, নয় প্রকার ভাজা নিবেদন করা হয়। দশমীতে নিবেদিত হয় খই-দই। কমলেকামিনী দেবী চণ্ডী বা পার্বতীর (মতান্তরে গজলক্ষ্মী কিংবা মনসা) রূপান্তর হলেও দুর্গাপুজোর সঙ্গে এই পুজোর কিছু অমিল রয়েছে। এই পুজোয় বোধন, মহাস্নান বা নবপত্রিকা স্থাপন হয় না, তবে নবমীতে হোম হয়। আনন্দ পুরস্কারপ্রাপ্ত সাহিত্যিক রামকুমার মুখোপাধ্যায় পুরস্কারসভায় প্রদত্ত নিজ বক্তৃতায় বলেছেন যে, কমলেকামিনী দেখার সৌভাগ্য হয়নি তাঁর। তাই তাঁকে আগামী জুন মাসে অনুষ্ঠিতব্য শহরের এই অভিনব পূজা তথা প্রতিমা দর্শনের আন্তরিক নিমন্ত্রণ জানাই সমগ্র জেলাবাসীর পক্ষ থেকে।
আলো-আঁধারি, না গূঢ়ার্থ-সন্ধান
সুধীর চক্রবর্তীর ‘আমার প্রথম বই’ শীর্ষক লেখায় (রবিবাসরীয় ২৮-৪) একটি বাক্য চোখে পড়ল: ‘সংগৃহীত শত শত গানের অন্তর্গত অর্থ বিশ্লেষণ করতে করতে ক্রমে ধরতে শিখি তার গূঢ়ার্থ ও সন্ধ্যাভাষার দ্যোতনা।’ ‘সন্ধ্যাভাষা’ এই বানানটি নিয়ে কিছু কথা বলা জরুরি। প্রেসিডেন্সি লাইব্রেরি থেকে প্রকাশিত কাজী আবদুল ওদুদ ও অনিলচন্দ্র ঘোষ সংকলিত ‘ব্যবহারিক শব্দকোষ’-এ ‘সন্ধ্যাভাষা’ শব্দটি আছে। অর্থ: ‘সাধারণের দুর্বোধ্য সংকেতপূর্ণ ভাষা।’ তবে এই দুই অভিধানকার য-ফলাবিহীন ‘সন্ধাভাষা’ শব্দটিকেও রেখেছেন। ‘সংসদ বাংলা অভিধান’-এ ‘সন্ধা’ শব্দটিই নেই। এবং ‘সন্ধ্যাভাষা’র অর্থ দেওয়া হচ্ছে: “বৌদ্ধ সাধকদের রচিত ‘চর্যাপদ’-এ ব্যবহৃত ভাষা, যার মধ্যে ধর্মকথার ভিতর একটা অন্য ভাবের কথাও আছে, কিন্তু তা অস্পষ্ট।” রাজশেখর বসু তাঁর ‘চলন্তিকা’-য় ‘সন্ধ্যাভাষা’ শব্দের অর্থ দিয়েছিলেন, ‘যে ভাষা কতক বুঝা যায়, কতক বুঝা যায় না। প্রহেলিকাময়ী ভাষা, যেমনচর্যাপদের ভাষা।’ রাজশেখর সম্ভবত অভিধান রচনার সময় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর কথা মনে রেখেছিলেন। নেপাল রাজদরবার থেকে চর্যাপদগুলিকে খুঁজে বের করেছিলেন যিনি, সেই হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছিলেন ‘সন্ধ্যাভাষার মানে আলো আঁধারি ভাষা, কতক আলো, কতক অন্ধকার, খানিক বুঝা যায়, খানিক বুঝা যায় না...।’ এমনিতে সন্ধ্যা বলতে তো দিন-রাত্রির সন্ধিকালকে বোঝায়। দিনের আলো নিভে আসছে, রাত ঘনিয়ে এল। আলো ছায়া কাজ করে যাচ্ছে। কাজেই এই আলোছায়ার ছবির সঙ্গে মানে বোঝা না-বোঝার বিষয়টি যেন বেশ মিলে যায়।
য-ফলাবিহীন ‘সন্ধা’ শব্দটি কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সন্ধা [সম্+ধা (ধাতু) অ] মানে সন্ধান। আগ্রহী পাঠক হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ দেখে নিতে পারেন। যাঁরা গূঢ়ার্থবোধক গান লিখছেন তাঁদের কাছে সে ভাষা ‘সন্ধাভাষা’, য-ফলা নেই। কারণ তাঁরা তো বিশেষ সন্ধানের উদ্দেশ্য নিয়েই শব্দগুলি ব্যবহার করছেন। সেই গূঢ়ার্থের সন্ধান যাঁরা রসিক তাঁরা জানেন।
সাধারণ মানুষের কাছে এ আলো-আঁধারির ভাষা হতে পারে, সাধকদের কাছে তা মোটেই আলো-আঁধারির ভাষা নয়। বিধুশেখর শাস্ত্রী ও প্রবোধচন্দ্র বাগচী য-ফলা বর্জন করলেন। তাঁদের মতে, ‘সন্ধ্’ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন ইচ্ছা বা অভিপ্রায়মূলক গান এগুলি। সন্ধাভাষার গান, য-ফলা চলবে না। চর্যাপদের টীকাকার মুনিদত্ত য-ফলা বাদ দিয়েছেন, আবার ব্যবহারও করেছেন। ‘সন্ধাভাষা’, ‘সন্ধাভাষ’ যেমন আছে, য-ফলা যুক্ত ‘সন্ধ্যাবচন’ আছে। সুকুমার সেন দু’রকম বানানের ব্যুৎপত্তি নিয়েই আলোচনা করেছেন। তিনি ‘আলো-আঁধারির ভাষা’ এই অর্থ নেননি। তাঁর মত, ‘সন্ধ্যা (বা সন্ধা) ভাষার কোনও সম্পর্ক নাই দিবারাত্রির মোহানার সঙ্গে। শব্দটিতে ‘ধ্যৈ’ (বা ‘ধা’) ধাতুর অর্থ প্রকট আছে। যে ভাষায় বা যে শব্দে অভীষ্ট অর্থ অনুধ্যান করিয়া অর্থাৎ মর্মজ্ঞ হইয়া বুঝিতে হয় (সম+ধ্যৈ), অথবা যে ভাষায় বা শব্দে অর্থ বিশেষভাবে নিহিত (সম্+ধা) তাহাই সন্ধ্যা (অথবা সন্ধা) ভাষা।’ সুকুমার সেন তাঁর ‘চর্যাগীতি পদাবলী’ বইতে এ কথা লিখেছিলেন।
‘সন্ধ্যাভাষা’ না ‘সন্ধাভাষা’ কোনটি হবে সেই বিতর্ক সূত্রে এই কথাগুলি নতুন নয়। একটি চমৎকার লেখার সুবাদে পুরনো কথাগুলি ঝালিয়ে নেওয়া গেল।
বাংলা অনুবাদ
বিশ্বজিৎ রায়ের ‘ওরা পাঠায় মৃত্যুর পথে’ (৭-৪) প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এরিক মারিয়া রেমার্কের ‘অল কোয়ায়েট অন দি ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’-এর বাংলা অনুবাদ করেছিলেন মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়। প্রায় ষাট বছর আগে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.