কথিত আছে, রাবণ রামের পরম ভক্ত ছিলেন বলিয়াই তাঁহাকে শত্রুরূপে কামনা করিয়াছিলেন। মানুষ বন্ধু অপেক্ষা শত্রুকেই অধিকতর স্মরণ করে, ইহা অতি সাধারণ কথা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অ-সাধারণ। তিনি এবং তাঁহার দলীয় ভ্রাতা ও ভগিনীরা একাগ্রচিত্তে সি পি আই এমকে শত্রুরূপে স্মরণ করিতে করিতে মহাকরণের দরজা চিচিং ফাঁক করিয়াছেন, সেই মহাতীর্থে পৌঁছাইবার পরেও তাঁহাদের সি পি আই এম-মনস্কতায় কোনও ছেদ ঘটে নাই প্রতিপক্ষকে কী ভাবে একঘরে করিতে হইবে, কী ভাবে তাঁহাদের বিষধর সর্পের ন্যায় দমন করিতে হইবে, সেই তন্ত্রসাধনায় বিরাম নাই। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অসাধারণত্ব সেখানে নয়। তাঁহার প্রকৃত বৈশিষ্ট্য ইহাই যে, তিনি যখন প্রতিপক্ষের মোকাবিলায় সরব এবং সচল, তখনও তিনি প্রতিপক্ষেরই পরম অনুসারী। বামফ্রন্ট সরকার তথা তাহার সর্বশক্তিমান বড় শরিক যে পথ দেখাইয়া গিয়াছে, তৃণমূল কংগ্রেস একমনে সেই পথেই চলিয়াছে। পরিবর্তনের স্লোগান দিয়া যাঁহারা ক্ষমতায় আসিয়াছেন, তাঁহারা পূর্ববর্তী জমানার ঘানি টানিয়া চলিতে বদ্ধপরিকর এই বিসদৃশ বাস্তব হয়তো পশ্চিমবঙ্গ নামক বিসদৃশ রাজ্যটিরই প্রতীক।
অপরিবর্তনের সাম্প্রতিকতম এবং এক অর্থে চরমতম দৃষ্টান্ত পঞ্চায়েত নির্বাচন সংক্রান্ত ঘটনাবলি। মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে এবং পঞ্চায়েতমন্ত্রীর সেনাপতিত্বে সরকার রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সহিত কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ, আঠারো দিনে এই যুদ্ধ থামিবে বলিয়া ভরসা হয় না। আইনের লড়াই কত দূর গড়াইবে, তাহার পরিণতি কী হইবে, সে সকলই আদালতের বিচার্য। কিন্তু লক্ষ করিবার বিষয়, যে আইনটিকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করিয়া রাজ্য সরকার কমিশনের উপর আপন আধিপত্য জাহির করিতে তৎপর, তাহা বামফ্রন্ট সরকারের প্রবর্তিত আইন। এই বিষয়ে শেষ কথা বলিবে আদালত, কিন্তু অন্তত এখনও পর্যন্ত বলা চলে যে, সেই আইনে রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে রাজ্যের পঞ্চায়েত বা পুরসভা নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দেওয়া হয় নাই, কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের অপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতার মাপকাঠিতে বিচার করিলে রাজ্য নির্বাচনের কমিশনের স্বাধীনতা হয়তো কিছুটা সীমিত। তাহাই রাজ্য সরকারের ভরসা, সেই ভরসা সম্বল করিয়াই পঞ্চায়েতমন্ত্রী দুই বেলা নির্বাচন কমিশনারের উদ্দেশে রকমারি তোপ দাগিতেছেন। ভাগ্যে বামফ্রন্ট নির্বাচন কমিশনের হাতে সরাসরি সব ক্ষমতা তুলিয়া দেয় নাই, এমন একটি অঙ্কুশ রাজ্য সরকারের হাতে রাখিয়াছে! মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেববাবুর প্রতি অন্তত বামহস্তে একটি ফুল ছুড়িলে ভাল করিবেন।
তৃণমূল কংগ্রেস যদি সত্যই পরিবর্তন চাহিত, তবে এই পঞ্চায়েত নির্বাচনই হইতে পারিত সেই সদিচ্ছা প্রমাণের এক উৎকৃষ্ট উপলক্ষ। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে কুক্ষিগত অথবা অন্তত প্রভাবিত করিবার যে অপচেষ্টা বামফ্রন্ট জমানার প্রধান কলঙ্ক হিসাবে চিহ্নিত হইয়াছে, সেই ধারা হইতে সম্পূর্ণ সরিয়া আসিবার নিষ্ঠাই ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিকট প্রত্যাশিত। আইন যাহাই বলুক, তাঁহার কর্তব্য ছিল কার্যক্ষেত্রে পঞ্চায়েত বা পুরসভা নির্বাচন আয়োজনের সমস্ত অধিকার কমিশনের হাতে ছাড়িয়া দেওয়া। তাহা হইলে পশ্চিমবঙ্গ যথার্থ গণতান্ত্রিকতার এক উজ্জ্বল প্রতীক হিসাবে নিজেকে তুলিয়া ধরিতে পারিত এবং তিনি বলিতে পারিতেন ইহা বামফ্রন্টের পশ্চিমবঙ্গ নহে, ইহা নূতন পশ্চিমবঙ্গ, এখানে নির্বাচন কমিশন বা অন্য কোনও প্রতিষ্ঠানের কাজে সরকার বা দল হস্তক্ষেপ করে না। কিন্তু দলের নাম এবং পতাকার রং ভিন্ন হইলেই মানসিকতা ভিন্ন হয় না। যে আধিপত্যকামিতা সি পি আই এমের স্বভাবগত, তাহাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও চরিত্রলক্ষণ। বস্তুত, এই দখলদারি কার্যত দলনির্বিশেষে ভারতের রাজনৈতিক নায়কনায়িকাদের মজ্জাগত। কয়লাঘটিত তদন্তে সি বি আইয়ের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের আচরণ তাহার নূতন প্রমাণ। বস্তুত, সুপ্রিম কোর্টের কঠোর তিরস্কারের মূল লক্ষ্য একটিই: প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই স্বাধীনতার মর্যাদা দিয়া স্বাতন্ত্র্যের অভিজ্ঞান পেশ করিতে পারিতেন। পারিলেন না। বামফ্রন্টের ধ্বজাই নিষ্ঠা সহকারে ধরিয়া থাকিলেন। |