পুজো শুরুর আগেই পৌঁছে যেতেন ১০৮ জন ঢাকি। আসতে তাঁদের হতোই, কারণ, ঢাকি-বরণ না করে উৎসবের সূচনাই যে করা যেত না। তবে তা প্রায় ছ’দশক আগের কথা। এখন ঢাকির সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১২। তা বলে রেওয়াজ পাল্টায়নি, ভক্ত সমাগমও কমেনি সাধক কবি ভবা পাগলার ভবানী পুজোয়। শনিবার থেকে কালনায় ভবানী মন্দিরে শুরু হয়েছে সাত দিনের সেই উৎসব।
এলাকার প্রবীণেরা জানান, ঢাকার আমতা গ্রামের সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন ভবেন্দ্রমোহন চৌধুরী। ছোট থেকেই ভবানীর সাধক তিনি। গান, কবিতা থেকে শ্লোক লেখা, সবেতেই বেশ দক্ষ ছিলেন। স্বাধীনতার পরে ওপার বাংলার ভিটে ছেড়ে পরিবার নিয়ে চলে আসেন কালনায়। শহর লাগোয়া হাসপুকুর এলাকায় থাকতে শুরু করেন। ১৩৫৭ বঙ্গাব্দে তৈরি করেন ভবানী মন্দির। কাশী থেকে কষ্টিপাথর আনিয়ে কলকাতার এক শিল্পীকে দিয়ে তৈরি করান প্রতিমা। গান, কবিতা লেখাও চলত সমান তালে। নিজের হাতে ভক্তদের পাঠানো চিঠির উত্তর দিতেন। তাঁর লেখা প্রায় ১২ হাজার গান সংরক্ষিত রয়েছে তাঁর পরিবারের কাছে। |
বছরের প্রতি দিন পুজো হলেও মহাপুজোর আসর বসত বৈশাখের শেষ শনিবার। এখনও তাই। আগের মতোই দেশ-বিদেশের প্রচুর মানুষ এসে যোগ দিতেন এই অনুষ্ঠানে। এ বার অবশ্য একটু আলাদা। মন্দিরের ভিতরে তৈরি করা হয়েছে মঞ্চ। রাজ্যের প্রায় সব জেলা থেকেই বিভিন্ন শিল্পী এসেছেন ভবা পাগলার গান শোনানোর জন্য। রয়েছে বাউল থেকে হরিনাম সংকীর্তন শিল্পী। আকর্ষণ রয়েছে কবিগানেরও। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, বেশিরভাগ শিল্পীকেই কিন্তু আলাদা করে আমন্ত্রণ জানানো হয় না। তাঁরা নিজের ইচ্ছেতেই গান শোনাতে আসেন।
ভবানী দেবীর বিষ্ণুরূপ। তাঁর হাতে শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম। শনিবার মহাপুজো শুরুর আগের দিন দুপুরে দেবীকে ‘বিষ্ণুরূপ’ পরিত্যাগ করানো হয়। উৎসবের সাত দিন তিনি থাকেন নিরাবরণা। সাধক কবির নাতি রণজিৎ চৌধুরি বলেন, “সপ্তাহ খানেক পর মা ভবানী আবার শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম হাতে বিরাজ করবেন। ব্যতিক্রম শুধু এই সময়টুকু। দাদুর আমল থেকেই এ রেওয়াজ চলে আসছে। দাদু বলতেন, মা বিশ্বপ্রসবিনী। তাই পোশাক পরার সময় নেই।” এ দিনই সন্ধ্যায় হয় ঢাকি বরণ।
মহাপুজোর দিন সকালে নানা রঙীন পতাকা নিয়ে বের হয় শোভাযাত্রা। শেষ হয়ে ভাগীরথী মাঠে। সেখান থেকে জল তুলে দেবীর ঘট প্রতিষ্ঠা হয়। সন্ধ্যায় আরতি। দেবীকে নিবেদন করা হয় আদা, কলা, শসা, আম এবং কুমড়ো। সাধককবির বড় নাতি সঞ্জয় চৌধুরীর কথায়, “এখানে দাদুই সব। তাঁর টানে হাজার হাজার মানুষ আসেন। আমরা চেষ্টা করি তাঁর দেখানো বিধিই অনুসরণ করতে।”
ভবানী মন্দির জুড়ে রয়েছে সাধক কবির অজস্র স্মৃতি। মন্দিরের ভিতরে রাখা রয়েছে কবির প্রিয় পিয়ানো, বাঁশি বা নিজের হাতে আঁকা ছবি। ভক্তদের লেখা চিঠিও রাখা রয়েছে সযত্নে। বাইরের বেশ কিছু ফলকে লেখা কবির বাণী। উৎসবে এসেছেন ইতালির কারোলা লোরা। তিনি বলেন, “ভবা পাগলা নিয়ে আগে থেকেই অনেক তথ্য জানা ছিল। এখানে এসে আরও জানলাম।” শুধু তিনি নন, উৎসবে আসা হাজার হাজার মানুষও এই সাত দিন খুঁজে ফেরেন তাঁদের প্রিয় ভবা পাগলাকে। |