একে একে নিভিছে দেউটি!
এসএসকেএম হাসপাতালের নবজাতক বিভাগের আন্তর্জাতিক প্রকল্প বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আগেই। এ বার বন্ধ হওয়ার উপক্রম ঘটল ওই বিভাগের ‘নিউরো ডেভেলপমেন্ট সেন্টার’টিও। ফলে নবজাতকদের মস্তিষ্কের বিকাশ নিয়ে যে গবেষণা পূর্বাঞ্চলে একমাত্র এই সরকারি প্রতিষ্ঠানেই শুরু হয়েছিল, তা এখন পুরোপুরি অনিশ্চিত হয়ে পড়ল। রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, টাকার জোগান নিয়ে সমস্যার জেরেই প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যেতে চলেছে।
নবজাতক বিভাগের প্রাক্তন প্রধান চিকিৎসক অরুণ সিংহের অনুপস্থিতিই এমন একটি প্রকল্পের অনিশ্চয়তার জন্য দায়ী বলে মনে করছেন স্বাস্থ্যকর্তাদের একটি বড় অংশ। তাঁদের বক্তব্য, নবজাতকের কান্নার অর্থ থেকে শুরু করে শ্রবণ, দৃষ্টিশক্তি এবং মস্তিষ্কের বিকাশের নানা খুঁটিনাটি ধাপ সবেরই অর্থ খোঁজার চেষ্টা চলছিল ওই কেন্দ্রে। দেশের বিভিন্ন অগ্রণী চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে আইআইটি খড়্গপুরের মতো শিক্ষাকেন্দ্রের সঙ্গেও যৌথ ভাবে চলছিল নানা প্রকল্প। অরুণবাবু নিজে উদ্যোগী হয়ে দেশ-বিদেশের নানা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে কাজটি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। আচমকাই তাঁকে অন্যত্র বদলি করে দেওয়া হয়। আর বদলি করা হয় এমন একটি মেডিক্যাল কলেজে, যেখানে নবজাতকদের পৃথক বিভাগটিই নেই। স্বাস্থ্যকর্তাদের একাংশের অভিমত, সরকারের এই সিদ্ধান্তের পরে স্বাস্থ্য-প্রকল্পের উপর আস্থা রাখতে পারছে না বহু সংস্থাই। ফলে অনুদান দেওয়া থেকে শুরু করে গবেষণা সংক্রান্ত তথ্যের আদানপ্রদান, সবই একে একে বন্ধ হচ্ছে। এমনকী, ইংল্যান্ডের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথ ভাবে গবেষণা চালানোর যে আলোচনা প্রায় পাকা হয়েছিল, ভেস্তে গিয়েছে সেটিও। এসএসকেএমের এক কর্তা বলেন, “নবজাতক বিভাগের বর্তমান প্রধান চিকিৎসক ইংল্যান্ডে গিয়ে কথাবার্তাও বলে এসেছিলেন। কিন্তু অরুণ সিংহকে সরানোর পরে কেউ আর আস্থা রাখতে পারছে না।”
নবজাতক বিভাগের এক চিকিৎসকের কথায়, “নিউরো-ডেভেলপমেন্ট মডেল তৈরি করতে সময় লেগেছে ন’বছর। এ দেশে বিষয়টি নিয়ে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনও কাজ হয়নি। তাই এর কোনও মডেলও নেই। প্রথম কয়েক বছর চিকিৎসকেরা নিজেদের পকেট থেকে টাকা খরচ করে কাজটি করলেও পরে ছোটখাটো অনুদান আসা শুরু হয়। ২০১২ সালের গোড়ায় একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা দু’বছরের জন্য আর্থিক সাহায্য করবে বলেও জানিয়েছিল। কিন্তু অরুণ সিংহকে সরানোর অব্যবহিত পরে তারাও সিদ্ধান্ত বদল করে।” অর্থাৎ, বিষয়টি এখন বিশ বাঁও জলে।
অরুণবাবুকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “প্রকল্প যদি বন্ধ হয়ে যায়, তা হলে তা খুবই দুর্ভাগ্যের। কিন্তু আমার পক্ষে এ নিয়ে কিছু বলা সম্ভব নয়। যখন এসএসকেএমে ছিলাম, যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি।”
রাজ্যে মা ও শিশুদের মৃত্যুর হার কমাতে টাস্ক ফোর্স গড়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার পরেও শিশু-স্বাস্থ্যের উন্নয়নে এমন একটি কেন্দ্র কেন মুখ থুবড়ে পড়ছে সে নিয়ে ইতিমধ্যেই স্বাস্থ্য দফতরে জোর জল্পনা শুরু হয়েছে। টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “বন্ধ হচ্ছে কে বলল? যত দূর জানি, কেন্দ্রীয় সরকারই এই প্রকল্পে টাকা দেবে বলে স্থির করেছে।” সেটা কি তাদের লিখিত ভাবে জানানো হয়েছে? ত্রিদিববাবুর উত্তর, “না। সরকারি ভাবে আমাদের কিছু জানানো হয়নি।”
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক সূত্রের খবর, রাজ্যের আবেদনের ভিত্তিতে প্রকল্পটি রাষ্ট্রীয় বাল স্বাস্থ্য কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে ভাবনাচিন্তা চলছে। তবে এখনও এ ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের এক কর্তা বলেন, “বিষয়টি কেন্দ্রীয় প্রকল্পের আওতায় এলে হয়তো এসএসকেএমে প্রকল্প সীমাবদ্ধ থাকবে না। অন্য কয়েকটি রাজ্যকেও এর অন্তর্ভুক্ত করা হবে।”
এর আগে নরওয়ে সরকারের আর্থিক সহায়তায় এসএসকেএম হাসপাতালের নিওনেটোলজি বিভাগে একটি প্রকল্প শুরু হয়েছিল। নরওয়েতে প্রতি হাজারে শিশু-মৃত্যুর সংখ্যা তিন। আর এ রাজ্যে সেটাই ৩২। শিশুর নিরাপদ জন্ম, মা ও সদ্যোজাতের পরিচর্যা, ছ’মাস বয়স পর্যন্ত শুধু বুকের দুধই খাওয়ানোর মতো মাপকাঠিতে নরওয়ে গোটা বিশ্বের মধ্যে প্রথম সারিতে। তাই সে দেশের সঙ্গে প্রকল্প চললে রাজ্যের নবজাতক চিকিৎসায় অনেকটাই উন্নতি ঘটবে বলে আশা করা হয়েছিল। শুধু প্রকল্প নয়, এসএসকেএমের নবজাতক বিভাগের সামগ্রিক উন্নয়ানের জন্য আর্থিক বরাদ্দও করেছিল নরওয়ে সরকার। দু’টিই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কলকাতার বদলে এ বার ওই প্রকল্প পেতে চলেছে দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেস বা এইমস।
|