|
|
|
|
ঋণ নিয়ে সাইকেল স্ট্যান্ড বানিয়ে দিলেন শিক্ষিকাই |
কিংশুক গুপ্ত • ঝাড়গ্রাম |
ছুটির পরে নিজের সাইকেলটা খুঁজে নিতে আর অসুবিধা হয় না ঝাড়গ্রাম ননীবালা বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের। প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে ঋণ নিয়ে তাদের জন্য সাইকেল স্ট্যান্ড বানিয়ে দিয়েছেন স্কুলেরই ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা মনোরমা ঘোড়াই।
স্কুলে ছাত্রী সংখ্যা হাজারখানেক। দু’দফায় স্কুলের চারশো পড়ুয়াকে সাইকেল দিয়েছে রাজ্য সরকার। ব্যক্তিগত সাইকেল নিয়ে স্কুলে আসে আরও কয়েকশো পড়ুয়া। সব মিলিয়ে প্রায় আটশো ছাত্রীর সাইকেল রাখার জন্য নির্দিষ্ট জায়গা ছিল না স্কুলে। ছুটির পর ইতিউতি স্তূপীকৃত করে রাখা সাইকেলের ভিড়ে নিজেরটি খুঁজে পেতে কালঘাম ছুটত ছাত্রীদের। স্কুল ভবনের জন্য সর্বশিক্ষা মিশন অনুদান দিলেও সাইকেল স্ট্যান্ডের জন্য আলাদা করে বরাদ্দ করে না। বছর সাতান্নর মনোরমাদেবী নিজের উদ্যোগে দু’লক্ষ পঁচিশ হাজার টাকা খরচ করে ১৩৭ ফুট লম্বা আর ১৬ ফুট চওড়া সাইকেল স্ট্যান্ডটি তৈরি করে দিয়েছেন। সেখানে এখন ছাত্রীরা সাইকেল রাখছে। শুধু তাই নয়, স্ট্যান্ডে ক্লাস ভিত্তিক পৃথক লেনও করে দেওয়া হয়েছে। যাতে সহজেই সাইকেলটি খুঁজে নিয়ে পারে পড়ুয়ারা।
নিজের এই উদ্যোগকে অবশ্য ‘সিন্ধুতে বিন্দু’ বলেই মনে করেন মনোরমাদেবী। তাঁর আদি বাড়ি পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলা থানার মালিগ্রাম পঞ্চায়েতের ছোট খেলনা গ্রামে। ছোটবেলায় পড়ে গিয়ে কোমরে চোট পেয়েছিলেন। সেই থেকে হাঁটাচলায় প্রতিবন্ধকতা থাকলেও মনের জোরের কাছে তা হার মেনেছে। |
|
টিচার ইন চার্জ মনোরমা ঘোড়াই ও ঝাড়গ্রাম ননীবালা বালিকা বিদ্যালয়
প্রাঙ্গণে সাইকেল স্ট্যান্ড। ছবি: দেবরাজ ঘোষ। |
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতে এমএ করার পরে ১৯৮৬ সালে ঝাড়গ্রাম শহরে ননীবালা বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দেন মনোরমাদেবী। এর পরে শিক্ষকতার সঙ্গেই দূরশিক্ষার মাধ্যমে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাতে এমএ করেন। বিয়ে করেননি। ঝাড়গ্রাম শহরে বাড়ি ভাড়া নিয়ে একাই থাকেন।
মনোরমাদেবীর কথায়, “২৭ বছর আগে যখন এই স্কুলে আসি, দেখেছিলাম সাইকেল স্ট্যান্ড না থাকায় ছাত্রীদের অসুবিধা হচ্ছে। তখনই ঠিক করেছিলাম, কোনও দিন সুযোগ হলে বড়সড় সাইকেল স্ট্যান্ড বানিয়ে দেব। কিন্তু সঙ্কোচে সে কথা স্কুল কর্তৃপক্ষকে প্রথমে জানাতে পারিনি।” গত বছর প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে ঋণ নেন মনোরমাদেবী। এরপর তৎকালীন প্রধান শিক্ষিকা বকুল হোতা-র কাছে গিয়ে নিজের ইচ্ছের কথা জানান তিনি। বকুলদেবী বলেন, “মনোরমা পিএফ থেকে ঋণ নিয়েছিল। সেই টাকায় ও স্ট্যান্ড বানাতে চায় জেনে সেদিন আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল।” স্কুল পরিচালন কমিটি মনোরমাদেবীর এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে স্কুল প্রাঙ্গণে সাইকেল স্ট্যান্ড করার অনুমতি দেয়। গত বছর নভেম্বরে কাজ শুরু হয়।
স্কুলের শিক্ষাকর্মী সিদ্ধিনাথ ভট্টাচার্য বলেন, “ঠিকাদার দিয়ে কাজ করানোয় মনোরমাদির আপত্তি ছিল। কাজের মান যাতে ভাল হয়, তার জন্য তিনি নিজের উদ্যোগে মিস্ত্রি লাগিয়ে স্ট্যান্ডটি তৈরি করিয়েছেন।” ইতিমধ্যে গত জানুয়ারিতে অবসর নেন প্রধান শিক্ষিকা বকুল হোতা। মনোরমাদেবী ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পান। গত ২ মে বকুলদেবীকে দিয়েই স্ট্যান্ডটির উদ্বোধন করা হয়। স্কুলের পড়ুয়া ষষ্ঠ শ্রেণির হরিপ্রিয়া বাগাল, দশম শ্রেণির শর্মিষ্ঠা সিংহ, দ্বাদশ শ্রেণির শম্পা রায়, মনীষা মণ্ডলেরা উচ্ছ্বসিত গলায় বলে, “আগে যেখানে-সেখানে সাইকেল রাখতাম। গরমে টায়ারও ফেটেছে অনেকের। এখন ছাউনি দেওয়া স্ট্যান্ড হওয়ায় সমস্যা মিটেছে।”
আর তিন বছর পর অবসর নেবেন মনোরমাদেবী। তিনি বলেন, “স্কুলের একটি মুক্তমঞ্চ আছে। গ্রীষ্মে রবীন্দ্রজয়ন্তী করতে ছাত্রীদের খুবই কষ্ট হয়। ওখানে ছাউনি দেওয়া স্থায়ী মঞ্চ করার ইচ্ছে আছে। কিন্তু বাদ সাধছে বিপুল খরচ। হাল ছাড়িনি। দেখি কিছু করতে পারি কি না।” |
|
|
|
|
|