দোষারোপ অব্যাহত। মেয়েদের উচ্ছৃঙ্খল ব্যবহারের কারণেই ধর্ষণ হইয়া থাকে সম্প্রতি আবার, আরও এক বার এই ধরনের মন্তব্য শোনা গেল। প্রবক্তা মধ্যপ্রদেশ কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক। একটি সভায় তিনি বলিয়াছেন, মেয়েরা চোখের ইশারা না করিলে কোনও পুরুষ অশালীন আচরণ করে না। বিস্মিত হইবার কোনও কারণ নাই, পিতৃতন্ত্রের ধারক-বাহকরা এই রূপ কথা বলিয়াই থাকেন। এই ধরনের মন্তব্যের কঠোর সমালোচনা করা নিশ্চয়ই উচিত কাজ। নিরন্তর ধর্ষণ হইয়া চলিতেছে, নিরন্তর মেয়েদের উপরেই দোষারোপ চলিতেছে ইহা একটি সভ্য সমাজের রীতি হইতে পারে না। কিন্তু মর্মান্তিক সত্য ইহাই যে, এই দেশের বহু নাগরিক, মুখে উচ্চারণ না করিলেও, মনে মনে এই মতই পোষণ করেন যে, মেয়েরা নিজেদের দোষেই লাঞ্ছিত হইয়া থাকে। উচ্চারণ করিলে তবেই ব্যাধি ধরা পড়ে। ব্যাধি কিন্তু সুগভীর, পরিব্যাপ্ত, প্রজন্ম হইতে প্রজন্মে বাহিত।
কেন এমন ঘটে? কেন বহু পুরুষ এবং সম্ভবত বহু নারীও মেয়েদের লাঞ্ছনার জন্য মেয়েদেরই দায়ী করেন? কেন পুরুষতন্ত্র এমন ধারণাকে লালন করে? সম্ভবত তাহার একটি কারণ, পুরুষতন্ত্রের তান্ত্রিকদের নিজের উপর কোনও নিয়ন্ত্রণ নাই। এমনকী নিজেকে সংযত রাখিতে পারিবে, এমন ভরসাটুকুও নাই। অতএব পুরুষতন্ত্র ধর্ষণের দায় চাপাইয়া দেয় মেয়েদের উপর। এই ভাবে সে নিজের কৃতকর্মের পাপক্ষালন করিয়া থাকে। কথায় কথায় সামাজিক স্থিতি এবং পবিত্রতার অজুহাত খাড়া করিয়া মেয়েদের দায়ী করিতে তৎপর হয়, সেই দোষারোপে তাহার সহায় হয় দীর্ঘকালের লালিত সামাজিক ধারণা, যে ধারণা বহুলাংশে পুরুষতন্ত্রেরই সন্তান। দায় অন্যের ঘাড়ে না চাপাইতে পারিলে সেই কাজের দায়িত্ব লইতে হইবে এবং সর্বোপরি নিজের নিকট জবাবদিহি করিতে হইবে। যে জবাবদিহি হয়তো পুরুষতন্ত্রের ভিত নড়াইয়া দিতে পারে।
তাহার কারণ, পুরুষতন্ত্র ক্ষমতার তন্ত্র। আর ক্ষমতা নিজেকে প্রশ্ন করিতে চাহে না। নিজের নিকট জবাবদিহি করিতে তো চাহেই না। স্বাভাবিক। প্রশ্ন করিলে সমস্ত কার্যের কারণ দর্শাইতে হয় এবং ফলের দায়িত্ব লইতে হয়। এই দুইটিই অতি বিষম কাজ। অতএব পুরুষতন্ত্র আপন অন্যায়ের দায় ক্রমাগত মেয়েদের উপর চাপাইয়া দিতে প্রবৃত্ত হয়। এই রীতি কেবল পুরুষের বা পুরুষতন্ত্রের নহে। ইহা সামগ্রিক ভাবেই ক্ষমতার স্ব-ভাব। যেখানেই ক্ষমতা, সেখানেই ইহা দেখা যায়। উচ্চপদস্থ কর্মচারী অধস্তন কর্মচারীর ওপর অন্যায় জুলুম করিয়া থাকেন, চাকুরিরত বড় দাদা বেকার ভাইয়ের ওপর অন্যায় রাগ দেখাইয়া থাকেন। ঘরে বা বাহিরে, ক্ষমতা কোনও অবস্থাতেই নিজের দায় স্বীকার করিতে চাহে না। আবার, সেই কারণেই ক্রমাগত ক্ষমতাতন্ত্রকে কঠিন প্রশ্নের মুখে ফেলা আবশ্যক। ‘ক্ষমতাকে সত্য বলিবার’ গুরুত্ব এইখানেই। মেয়েদের লাঞ্ছনার জন্য মেয়েদেরই দায়ী করিবার যে কোনও চেষ্টাই তাই প্রবল প্রতিবাদের যোগ্য। |