কর্নাটকের বিধানসভা নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টির পরাজয়ের প্রধান কারণ অন্য কিছুই নয়, নির্বাচনী পাটিগণিত। কংগ্রেসের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাত অতি সামান্য বাড়িয়াছে, অথচ আসনসংখ্যায় নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা তাহার করায়ত্ত। ইহাতে কোনও রহস্য নাই। ঘটনা ইহাই যে, বিজেপি’র প্রাপ্ত ভোটের অনুপাত প্রায় পনেরো শতাংশ কমিয়াছে এবং তাহার প্রায় সম্পূর্ণটিই হস্তগত করিয়াছে বিদ্রোহী বি এস ইয়েদুরাপ্পার কর্নাটক জনতা পার্টি। তাহাতে কেজেপি’র নিজের বিশেষ সুবিধা হয় নাই আসনসংখ্যা মাত্র ছয়। কিন্তু বিজেপি’র সর্বনাশ হইয়াছে। ভারতীয় ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ নির্বাচনের ইহাই মহিমা। দুই প্রধান বিরোধী শিবিরের একটি ভাঙিলেই অন্যের সুবিধা। কংগ্রেস কর্নাটকে সেই সুবিধা লাভ করিয়াছে।
এই ফলাফলের অন্য তাৎপর্যটিও স্বপ্রকাশ। ইহা ঘটনা যে, দক্ষিণ ভারতে প্রথম শাসনক্ষমতা অর্জন করিয়া ভারতীয় জনতা পার্টি সেই সুযোগের লজ্জাকর অপব্যবহার করিয়াছে। ‘সুরাজ’-এর স্লোগান বা ‘স্বতন্ত্র চরিত্রের দল’ হিসাবে আত্মশ্লাঘাকে সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ করিয়াছে এক দিকে দুর্নীতির বিপুল অভিযোগ এবং অন্য দিকে পুরানো সামাজিক বিভাজনের বাহিরে নিষ্ক্রান্ত হইতে না পারিবার দুর্বলতা। ভূতপূর্ব মুখ্যমন্ত্রী ইয়েদুরাপ্পা এই সঙ্কটের প্রতিভূ হইয়া উঠিয়াছিলেন বটে, কিন্তু দলের সামগ্রিক ভাবমূর্তিও নিষ্কলঙ্ক ছিল না। অনেক সহ্য করিবার পরে ইয়েদুরাপ্পাকে অপসারণ করিয়া বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা দলের ‘পবিত্রতা’ জাহির করিতে চাহিয়াছেন। লাভ হয় নাই। কর্নাটকের ভোটদাতারা দুর্নীতির প্রশ্নে অত্যন্ত ভাবিত এবং বিচলিত বলিয়া মনে করিবার কোনও কারণ নাই। তাহা হইলে ইয়েদুরাপ্পার ঝুলিতে এই পরিমাণ ভোট পড়িত না। দুর্নীতির অভিযোগ সর্বদাই ভোটের বাক্সে প্রতিফলিত হয় না। সেই আশ্বাসে লোকসভা নির্বাচন লইয়া কংগ্রেস আশ্বস্ত বোধ করিলে অবশ্য নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দেওয়া হইবে। বফর্স ঘটিত ফাঁকা আওয়াজে উড়িয়া যাইবার অভিজ্ঞতাও এই দলের আছে।
কর্নাটকে বিজেপির অভিজ্ঞতা হইতে অন্য একটি শিক্ষণীয়ও স্পষ্ট। দুর্নীতিবিরোধী ভাবমূর্তির তাগিদেই হোক, দলের অন্তর্দ্বন্দ্বের মোকাবিলা করিতেই হউক, রাজ্য স্তরে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত চাপাইয়া দেওয়ার প্রবণতা আখেরে ভাল ফল দেয় না, কর্নাটক তাহা আবারও প্রমাণ করিল। যে সব রাজ্যে বিজেপির সাফল্য ইতিমধ্যে স্বীকৃত সেখানে রাজ্য স্তরের নেতৃত্বও স্বীকৃত, ‘জাতীয়’ অভিভাবকদের অঙ্গুলিহেলনে সেই রাজ্য নেতৃত্ব চলেন নাই বলিয়াই দলের একটি প্রশস্ত ভিত তৈয়ারি হইতে পারিয়াছে। কর্নাটকে, সন্দেহ নাই, বিজেপির সমস্যা অনেক বেশি জটিল ছিল। এই রাজ্যে দল তুলনায় নবাগত, তদুপরি লিঙ্গায়ত গোষ্ঠীর উপর ইয়েদুরাপ্পার প্রভাব, তদুপরি খনিজ সম্পদজনিত অস্বাভাবিক দুর্নীতি এবং লোকায়ুক্তের রায় সব মিলাইয়া খেলাটি কঠিন ছিল। কিন্তু এখন বিজেপিকে মূল সমস্যাটি লইয়া ভাবিতেই হইবে। কী ভাবে দলের রাজ্য স্তর হইতেই দলীয় নেতৃত্বের পুনরুজ্জীবন ঘটানো যায়, তাহাই লক্ষ্য হিসাবে স্থির করিতে হইবে।
দলের প্রশ্ন অতিক্রম করিয়া বৃহত্তর গণতন্ত্রের দিক হইতে দেখিলে, ইহা সুলক্ষণ। যুক্তরাষ্ট্র কেবল সংবিধানের প্রস্তাবনায় উচ্চারণের বিষয় নহে, কেবল কেন্দ্র, রাজ্য ও যুগ্ম তালিকায় বিভাজনের বিষয়ও নহে, যুক্তরাষ্ট্রের মর্যাদা ফলিত গণতন্ত্রের আচার-আচরণের মধ্য দিয়াই সার্থক করিয়া তোলা জরুরি। রাজ্যের ভোটদাতারা এবং রাজনৈতিক দলগুলির নেতৃত্ব যদি সেই যুক্তরাষ্ট্রীয়তাকে প্রতিষ্ঠিত করিতে চাপ দিয়া চলে, যুক্তরাষ্ট্রীয় আদর্শের ভবিষ্যতের পক্ষে তাহাই সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য উপায়। বিজয়ী কংগ্রেস যদি এই সত্যটি অনুধাবন করিতে পারে, তবে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা সরকার নির্ধারণে নির্বাচিত বিধায়কদের প্রাপ্য গুরুত্ব প্রদান অত্যাবশ্যক। মুখ্যমন্ত্রী পদের একাধিক দাবিদারের নাম শোনা যাইতেছে, ইহা অস্বাভাবিক নহে। কিন্তু সেখানেই যথার্থ গণতন্ত্রের পরীক্ষা। কংগ্রেসের পরিচিত ‘হাই কমান্ড’ নির্ভরতা ছাড়িয়া বিধায়কদের মত অনুসারে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাজ্য নেতৃত্ব বাছিয়া লওয়াই হইবে সুশাসনের পথে প্রথম পদক্ষেপ। |