মধ্যবিত্ত আইপিএল নায়ক
ভাবলে আশ্চর্যই লাগে এখন! রাহুল দ্রাবিড়কে যে প্রথম দেখায় ঠিক এখনকার ফচকে আইপিএল প্লেয়ার মনে হয়েছিল!
বেঙ্গালুরু, ১৯৯৬। বিশ্বকাপের আগে আজহারের ভারতের কন্ডিশনিং ক্যাম্প বসেছে। গোটা চল্লিশেক ক্রিকেটার নেওয়া হয়েছে। তাঁদের মধ্যে চূড়ান্ত ভাগ্যবান শেষ ষোলো বাছা হবে। দ্রাবিড় তত দিনে প্রতিশ্রুতিমান হিসেবে নাম করেছেন। বলা হচ্ছে মূল দলে ঢোকার সম্ভাবনা তাঁর পঞ্চাশ-পঞ্চাশ। যাঁর আশা খুব বেশি এবং ঢুকছেন-ই ধরে নিয়ে আগাম ইন্টারভিউ নিয়ে রেখেছি, তিনি পঞ্জাবের বিক্রম রাঠৌর। আজকের জাতীয় নির্বাচক। তখনকার নির্ভরযোগ্য ওয়ান ডে ক্রিকেটার। চালিয়ে খেলেন। প্রয়োজনে কিপিং করে দিতে পারেন। ভারতীয় ক্রিকেটে তখনও আজকের রমরমা আসেনি যে, হোটেলে ডাবল রুম সিঙ্গল অকুপেন্সি। ক্যাপ্টেন-কোচ বাদ দিয়ে সবাইকে রুম শেয়ার করতে হয়। আশ্চর্য আর সবার ঘরে রুমমেটকে দেখা যায়। একমাত্র রাঠৌরের ঘরে কেউ নেই। জিজ্ঞেস করে জানা গেল, আছে। কিন্তু সে ঘরেই থাকে না। যখন থাকে নিজের মতো করে, নিজের জগতে বুঁদ হয়ে থাকে। আর স্টিরিওতে ইংলিশ মিউজিক শোনে। যা বোঝা গেল, ছেলেটা শুধু কানে দুল পড়ে না। নইলে নব্বই দশকের বেপরোয়া তারুণ্যের কাছে যা যা আবেগসঙ্গত, যাবতীয় উপাদান রয়েছে। উদ্ধতও বটে। সাংবাদিকদের পাত্তা দেওয়া প্রয়োজন মনে করে না। অথচ বেঙ্গালুরুর মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। কোনও বাবা-কাকা ধরে নেই।
নাম রাহুল দ্রাবিড়!
আইপিএল ২০১৩
ম্যাচ রান
১২ ৩৬১
গড় সর্বোচ্চ
৩৬.১০ ৬৫
স্ট্রাইক রেট হাফ সেঞ্চুরি
১১৪.৯৬
(পরিসংখ্যান: ৭ মে ২০১৩, দিল্লি ডেয়ারডেভিলস ম্যাচ পর্যন্ত)
এর পর বিশ্বকাপ দল ঘোষণার রাত। রাঠৌর বিস্ময়কর ভাবে বাদ। সমবেদনা জানাতে ঘরে গিয়েছি। রাঠৌর মুহ্যমান অবস্থায় বসে রয়েছেন। ঘরে আলো জ্বলেও যেন মনে হচ্ছে কেউ বাইরের ফিউজটাই অফ করে দিয়েছে! সঙ্গী সাংবাদিক তারই মধ্যে জিজ্ঞেস করলেন, “ফচকে ছোঁড়াটা কোথায় গেল? আজও তো দেখছি ঘরে নেই। মালটা বাদ পড়ে কী বলল?” রাঠৌর মুখ তুললেন। এ বার তাঁকে বিষণ্ণর চেয়ে বিস্মিত দেখাচ্ছে বেশি। “আশ্চর্য। কিছুই বলল না। টিম শুনল। বলল, ও আমি নেই। লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে গেল।”
জাম্প কাট ২০১২। বেঙ্গালুরুরই একটা কফিশপে রাতে রাহুল দ্রাবিড়ের সামনে বসা। বললাম, জানেন তো এই শহরেই আপনার একটা রিঅ্যাকশনের কথা শুনেছিলাম যার সঙ্গে পরবর্তী কালে আপনাকে মেলাতে পারিনি। ও আমি নেই। বলে ক্যাজুয়্যালি ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া এটা আপনি কী করে হতে পারেন?
“ওটা আমিই ছিলাম,” তীক্ষ্ন চাউনিতে তাকালেন দ্রাবিড়। “কিন্তু কাহিনির পুরোটা বোধহয় বোঝেননি। আমি কী করতে পারতাম টিম থেকে বাদ পড়ে? গলা জড়িয়ে কাঁদতাম? চেঁচাতাম? তাতে কোনও লাভ হত? তার চেয়ে আমি ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে হিসেব করলাম, ইংল্যান্ড ট্যুরের সিলেকশনের আগে ক’টা রঞ্জি ম্যাচ পাচ্ছি? গুনলাম, খুব সম্ভবত চারটে পাব। নিজেকে বললাম চারটেতেই সেঞ্চুরি করতে হবে। করলামও। তার পর সিলেকশন হয়ে গেল।”
নিমেষে কফি আড্ডার পরিবেশটাই যেন বদলে গেল। এত বছর দেখছি দ্রাবিড়কে। কথা বলতে বলতে এই চোয়াল শক্ত হয়ে যাওয়া, তাকানোর ধরন বদলে যাওয়া কখনও দেখিনি। হঠাৎ যেন মনে হল, এর হাতে কফির কাপ নেই। ক্রিকেট ব্যাট আছে। এ ক্রিজে খেলছে। ওই তোড়ে রাহুল এটাও বলে ফেললেন, “আমি সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। আমার বাবা-মা আমাকে ঠিকঠাক শিক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু আমি জানতাম শুধুই ওঁদের ওপর ব্যাপারটা ছেড়ে দিলে আর টুকটাক ক্রিকেট খেললে আমার জীবনটা একটা খাতেই থেমে থাকবে।
বড়জোর ব্যাঙ্কে সামান্য চাকরি-টাকরি হতে পারে। আমার জীবন নিয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষা অনেক বেশি। সেই শখ মেটাতে হলে আমার ব্যাটিংকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিতেই হবে। ছোটবেলাতেই ঠিক করে নিই, সফল আমাকে হতেই হবে। আমার সামনে যে আর কোনও রাস্তা নেই।”
‘নীরব উচ্চাকাঙ্ক্ষী’ কথাটা বহু বার অনেককে লিখতে দেখেছি রয়্যালস অধিনায়ক সম্পর্কে। এই প্রথম সামনে থেকে দেখলাম!
গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল! আজ লিখতে গিয়েও দিচ্ছে!
লেখা হয়নি, কফি আড্ডাটা ছিল বেশ রাতের। চিন্নাস্বামীর আইপিএল ম্যাচ শেষে। জিজ্ঞেস করলাম, এই উচ্চাকাঙ্ক্ষাটা থাকত আজকের যুব আইপিএল নক্ষত্র হলে? রাহুল বললেন, “ইন্টারেস্টিং প্রশ্ন। আমি নিজেও বারবার নিজেকে জিজ্ঞেস করি, একুশ বছর বয়সে আমার হাতে লাখ-লাখ টাকা চলে এলে কি এই উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারতাম? এক-এক সময় মনে হয়, পারতাম না। টাকা ভেতরকার যন্ত্রণাকে জুড়িয়ে দিত। তার পরেই আবার মনে হয়, টাকাকে অগ্রাহ্য করে উঠে দাঁড়াতে পারতাম। আমার উচ্চাকাঙ্ক্ষা তো নিছক টাকার ছিল না। ছিল মর্যাদারও। সেটা এক্সেলেন্স থেকেই একমাত্র আসতে পারে।”
• অন্যের সাফল্য দেখে চোখ টাটিও না। তোমাকে ঈশ্বর তোমার নিজের লেন দিয়েছেন। সেখানে আপ্রাণ দৌড়ও। ধোনি যদি বিশ্বকাপ জেতায় ওয়াংখেড়ের আকাশে দেওয়ালি হয়। তাতে মন খারাপ না করে পরদিন সকালে চিন্নাস্বামীতে প্র্যাক্টিসে যাও। কে বলতে পারে, ইংল্যান্ড সফরে তোমার জন্যও ওভালে দিওয়ালি হবে না!
• আমোদে গা ভাসিও না। ঠিক করে নাও তোমার আমোদে বেশি আনন্দ? না সাফল্যে? জীবন এখানে বিকল্প দেয় না। এটা রেস্তোরাঁর মেনু কার্ড নয়
• আর এক জন এই মডেলটা অনুসরণ করেছে বলেই সেটা শ্রেষ্ঠ, তার কোনও মানে নেই। তুমি ভাবো, তোমার জন্য কোনটা সবচেয়ে উপযুক্ত? আর সেটাতেই আঁকড়ে থাকো। থার্ড স্লিপ থেকে ব্যাট নেমেও যদি তুমি সেঞ্চুরি পাও, লোকে কী বলল গ্রাহ্য কোরো না
• বংশানুক্রমিক গরিমার দিন শেষ আধুনিক পৃথিবীতে। রাজস্থান রয়্যালসের হয়ে যদি মহানৈপুণ্য করায়ত্ত করো, তা হলে যে সম্মান পাবে জয়পুরের গোলাপি প্রাসাদগুলোর বাসিন্দা হয়েও সেটা পাবে না

এ বারের আইপিএলে যত রয়্যালস অধিনায়কের প্রশংসা শুনছি, তত মনে হচ্ছে টিমের বাচ্চাদের সামনে এক-এক সময় তিনি ভেতরকার লোকটা হয়ে বেরিয়ে আসছেন তো? বলছেন তো যে, জীবনে এক্সেলেন্স মানে মর্যাদার। টাকা দিয়ে সেই গরিমা আসে না। দ্রাবিড়কে প্রথম মনে থেকে গিয়েছিল সাতানব্বইয়ের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর থেকে। তখন টিমে তিনি সবে এক বছর। কিন্তু কিংসটনের একটা ডিনারে দেখেছিলাম ভারতীয় সাংবাদিকদের ছোট ঝাঁককে তিনি প্রশ্ন করেছেন: আচ্ছা একটা কথা আমায় বলুন তো দেড়শো গজ দূরের প্রেসবক্সে বসে আপনারা কী করে বোঝেন, কোন বলটা ফরোয়ার্ড খেলা উচিত, কোনটা ব্যাক? আমি তো ক্রিজে মাত্র আঠারো গজ দূর থেকেও সময় সময় বুঝে উঠতে পারি না। স্তব্ধ হয়ে গেছিল সাংবাদিকদের ঠোঁটগুলো। দ্রাবিড় সরে যাওয়ার পর এক জন বলেছিলেন, “ফক্কর ছেলে। বেশি দিন টিকবে না।” সকলের অবশ্যই তা মনে হয়নি। সেই সফরেই অ্যান্টিগা মাঠের মাঝখান দিয়ে প্রাণপণে টেলেক্স বুথের দিকে ছুটছি। লেখা ধরাতে হবে। দ্রাবিড় থামিয়ে বললেন, “এ কী লেখা নিয়ে ছুটছেন কেন? আপনাদের লেট সিটি এডিশন এখনও চলে যায়নি?”
গত তিরিশ বছরে রাজ্য-জাতীয়-আন্তর্জাতিক এত সব ক্রীড়াবিদ দেখলাম। ‘লেট সিটি এডিশন’ শব্দটা কারও মুখে শুনিনি।
সত্যি বলতে কী, অনবরত এত প্রশ্নও শুনিনি কারও মুখে। তারকার সঙ্গে সাংবাদিকের দেখা হলে প্রশ্ন করাটা চিরকাল ওয়ান ওয়ে ট্র্যাফিকই হয়ে থাকে। সৌরভের মতো সৌজন্য কারও থাকলে বড়জোর সে হয়তো জিজ্ঞেস করবে, বাড়িতে সবাই ভাল তো? তার বাইরে পেশা-সমাজ-রাজনীতি-মিডিয়ার নতুন ভাষা সম্পর্কে ক্রমাগত কৌতূহল দ্রাবিড় ছাড়া কোনও আন্তর্জাতিক সেলিব্রিটির নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু তাঁর সঙ্গে এখনও দেখা হয়নি। আইপিএল আরও হবে। ভারতীয় ক্রিকেটের সৌরজগৎও আবর্তিত হবে। কিন্তু আর কারও মুখে কোনও সাংবাদিক এই অদ্ভুত প্রশ্নটা কখনও শুনবে?

কোভালাম বিচে রাহুল
“সবাই বলে কলকাতার কবিদের লেখার হাতটাই আলাদা। কোথায় গিয়ে ওঁদের কবিতা অন্য প্রদেশের কবিদের চেয়ে আলাদা?” কী উত্তর দেবেন? সময় সময় ঘেঁটে যাবে। তারকা কে?
কোথাও গিয়ে যেন দ্রাবিড়ের মধ্যে গ্রেগ চ্যাপেলীয় দর্শন কাজ করে: ইউ কান্ট স্ট্যান্ড স্টিল। ইউ আর আইদার মুভিং ফরোয়ার্ড অর গোয়িং ব্যাকওয়ার্ডস। যেহেতু পিছনে যেতে সম্মত নন, তাই নিজের সীমাবদ্ধতার মধ্যে সামনে যাওয়ারই নিরন্তর চাড়। তা থেকেই বোধহয় মাঠে-মাঠের বাইরে নিজেকে অবিরত উন্নত করার ঝোঁক।
তাঁর সমসাময়িকদের যদি দেখেন, সচিন ঐশ্বরিক ক্রিকেট-প্রতিভাসম্পন্ন। যা শতাব্দীতে হয়তো এক বারই আসে। কুম্বলে আরও সম্পন্ন পরিবারের উচ্চশিক্ষিত যুবক। সৌরভ বিত্তশালী পরিবারের সন্তান। জীবনে মাছের বাজার কাকে বলে দেখেননি। বাড়ির রেশন কোথা থেকে ওঠে, জীবনে খবর রাখতে হয়নি। দাপট তাঁর জন্মগত সম্পদ। সচিনের যেমন প্রতিভা। এঁরা সকলেও অনন্ত সমস্যাকে হারিয়ে আকাশে তারা হিসেবে এক-এক জন ফুটেছেন। কিন্তু রাহুলের মতো মধ্যবিত্ত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হয়নি কাউকে। মাটির কলসি থেকে সোনার কলসি হওয়ার প্রাণান্তকর দৌড়। একটু এ দিক-সে দিক হলেই যদি জীবনটা আবার ঠুনকো মাটির কলসির মধ্যবিত্ত পরিস্থিতিতে ফেরত যায়! তখন তো জীবনযুদ্ধেই হেরে যাওয়া হবে!
আর একটা দ্রাবিড়ীয় দর্শন: কখনও অভিযোগ কোরো না। অভিযোগ অনেক সময় ব্যক্তিগত মর্যাদাহানি ঘটায়। তার চেয়ে ডেল কার্নেগি প্রেসক্রিপশন অনুসরণ করো। দ্রুত খারাপটার সঙ্গে ধাতস্থ হয়েই উদ্যোগী হও, সেটাকে ঘোরাতে।
প্রথম নমুনা দিয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম। দ্বিতীয়টা পাঁচ বছর আগের পারথ। একই রকম ইন্টারেস্টিং।
কুম্বলের ভারত ওয়াকায় প্রথম টেস্ট ম্যাচ জেতার পরের দিন সকালে টিম হোটেলে হত্যে দিয়ে পড়ে রয়েছি। একটু পরেই ত্রিদেশীয় সিরিজের ওয়ান ডে দল নির্বাচন। যার অধিনায়ক ধোনি। তা ছাড়া জেতার ফলো-আপ স্টোরির জন্যও রিপোর্টারের এ ঘর-ও ঘর জরুরি। রাহুলের সঙ্গে লবিতে দেখা। স্ত্রীকে নিয়ে কোথাও বেরিয়ে যাচ্ছেন। ফেরার সময়ও দেখা হল। তখন প্রায় বিকেল। এ বার দেখলাম, একা।
চোখাচোখি হতেই বললেন, “সেই সব সাংবাদিকের স্তরে নিজেকে নামিয়ে আনছেন নাকি যারা হোটেলের ঘরে সব সময় আড়ি পাতে। আর অসহ্য কোটেশন নির্ভর জার্নালিজম করে। সকালেও দেখলাম লবিতে ঘুরঘুর করছেন। এখনও তাই।”
বললাম, আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম রাহুল। এখুনই ওয়ান ডে টিম ঘোষণা হল। আপনি বাদ। “আমি বাদ!” কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা। তার পরেই রাহুল জানতে চান, “দাদা?” বললাম, দাদা-ও বাদ। বলতে বলতে লিফটে ওঁর সঙ্গেই ওপরে উঠে এসেছি। বন্ধুর গলার আওয়াজ শুনে ততক্ষণে সৌরভ বার হয়ে এসেছেন ঘরের দরজা খুলে। রাহুল বললেন, “টিমটা শুনে নিও। আমরা দু’জনেই বাদ।” সৌরভকে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো দেখাল। ভাবতেই পারেননি সাম্প্রতিক সময় এত রান করার পর অন্তত ওয়ান ডে টিম থেকে তাঁকে খারিজ করা সম্ভব! রাহুল ততক্ষণে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন।
টিম শুনে প্রতিক্রিয়া? “কিছু নেই। আমাকে কোট করারই দরকার নেই।” বলে দিলেন।

কপিবুক ক্রিকেটার, আদর্শ পিতা
দু’বছর আগে ইংল্যান্ডে প্রচুর সংবর্ধনা সমেত তিনি বিদায়ী ওয়ান ডে খেলার সময় পারথের বিকেলটা মনে পড়ছিল। কী করেছিলেন সে দিন দরজাটা বন্ধ করার পর? হিসেব করেছিলেন বোধহয় মনে মনে, ক’টা গুরুত্বপূর্ণ টেস্ট পাচ্ছি আজকের জঘন্য বিচারটা বদলে দিতে? রাহুলের ব্যক্তিগত গবেষণাগারে তাই বব ডিলানের এই গানটা গুনগুন করে কখনও বাজবে না: কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায়। বরং বাজবে, কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক জিরোবে তার ব্যাট!
মাটির এত কাছাকাছি যাঁর সচেতন বিচরণ। তারকার প্রথম পার্থিব স্টেশন নার্সিসিজমকে যাঁর বরাবরের ঘেন্না। আশা করা যায় তিনি এটুকু বুঝবেন আইপিএলের চক্করটা এ বার শেষ করে দেওয়াই ভাল। আর তাই যদি হয়, রাহানে-স্যামসনদের দ্রাবিড়ীয় সভ্যতায় হাতেকলমে দীক্ষিত হওয়ার এই শেষ সুযোগ!
সেই সভ্যতার সোপান অবশ্যই কিছু দর্শন।
• অন্যের সাফল্য দেখে চোখ টাটিও না। তোমাকে ঈশ্বর তোমার নিজের লেন দিয়েছেন। সেখানে আপ্রাণ দৌড়ও। ধোনি যদি বিশ্বকাপ জেতায় ওয়াংখেড়ের আকাশে দেওয়ালি হয়। তাতে মন খারাপ না করে পরদিন সকালে চিন্নাস্বামীতে প্র্যাক্টিসে যাও। কে বলতে পারে, ইংল্যান্ড সফরে তোমার জন্যও ওভালে দিওয়ালি হবে না!
• আমোদে গা ভাসিও না। ঠিক করে নাও তোমার আমোদে বেশি আনন্দ? না সাফল্যে? জীবন এখানে বিকল্প দেয় না। এটা রেস্তোরাঁর মেনু কার্ড নয়।
• আর এক জন এই মডেলটা অনুসরণ করেছে বলেই সেটা শ্রেষ্ঠ, তার কোনও মানে নেই। তুমি ভাবো, তোমার জন্য কোনটা সবচেয়ে উপযুক্ত? আর সেটাতেই আঁকড়ে থাকো। থার্ড স্লিপ থেকে ব্যাট নেমেও যদি তুমি সেঞ্চুরি পাও, লোকে কী বলল গ্রাহ্য কোরো না।
• বংশানুক্রমিক গরিমার দিন শেষ আধুনিক পৃথিবীতে। রাজস্থান রয়্যালসের হয়ে যদি মহানৈপুণ্য করায়ত্ত করো, তা হলে যে সম্মান পাবে জয়পুরের গোলাপি প্রাসাদগুলোর বাসিন্দা হয়েও সেটা পাবে না।
দ্রাবিড়ের ওপেনিং পার্টনারের সঙ্গে গত আইপিএলের মাঝে এক দিন লম্বা কথা হচ্ছিল। অজিঙ্ক রাহানেও খুব কষ্ট করে উঠেছেন। কিন্তু মনে হল না অধিনায়কের সাফল্যকে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার ক্ষমতা তাঁর কখনও হবে বলে।
আইপিএল নামক প্রমোদ-তরণীতে দ্রাবিড় তো মধ্যবিত্তেরও নায়ক। তাঁকে ‘ওয়াল’ বলা হয় বলে বেঙ্গালুরু স্টেডিয়ামে বিশাল প্রাচীর স্থাপিত রয়েছে। যা পৃথিবীর আর কোনও ক্রিকেটারের সম্মানে কোথাও হয়নি। কিন্তু চল্লিশ বছরের মানুষটার এ বছরের আসল কীর্তি যেন মধ্যবিত্তের জন্যও অদৃশ্য সোনার প্রাচীর স্থাপন করে ফেলেছে। একটা লোক যে ওয়ান ডে-তে পর্যন্ত বহু খেটে নিজেকে উপযুক্ত করেছে। সে কখনও আক্রমণাত্মক খেলার সহজাত দক্ষতা নিয়ে আসেনি। সে কি না ক্রিকেটজীবনের প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে টি-টোয়েন্টিতে সাড়া ফেলে দিচ্ছে। একটা বাচ্চা টিম নিয়ে উঠে এসেছে অ্যাদ্দুর। ট্রফি যদি না-ও পায়, প্রাচীরের গ্লো সাইনটা তো আর মুছবে না!
ওহে মধ্যবিত্ত, পারিপার্শ্বিককে দোষ দিও না। অন্য কাউকে নিজের দুর্দশার জন্য অভিযুক্ত কোরো না। মানিয়ে নাও অবস্থার সঙ্গে। তার পর দৌড় শুরু করো এক্সেলেন্সের। দেখবে সেই রাস্তায় আপ্রাণ ছুটতে ছুটতে আশেপাশের রংগুলো সব বদলে যাচ্ছে। তখন মনে হবে টাকার কত ওপরে উঠে নীচের পৃথিবীটাকে দেখতে পাচ্ছি!

দীপের চোখে নতুন রাহুল
• আইপিএল সিক্সে রাহুল অনেক বেশি ঝুঁকি নিচ্ছে। সেটা অনেক সময়ই ক্যালকুলেটেড, আগের বছরগুলোয় রাহুলকে এত ঝুঁকি নিতে দেখিনি।

• এ বারে রাহুলের পায়ের মুভমেন্ট অনেক বেশি লাইট। ৪০ বছর বয়সে যেটা সত্যিই বিস্ময়ের!

• এই টুর্নামেন্টে ‘ওয়াল’কে দেখে বোঝা যাচ্ছে মেন্টালি ও কতটা ফ্লেক্সিবল। আগের রাহুল অনেক বেশি অনড় থাকতেন, তাই মাঝে মধ্যে রানও আটকে যেত। নতুন রাহুলের ক্ষেত্রে সেটা একেবারেই হচ্ছে না।

• টেস্ট ক্রিকেটে রাহুলের প্ল্যানিং থাকত ফুলপ্রুফ। কাকে কোন শট খেলব, কোন বোলারকে অ্যাটাক করব, স্ট্র্যাটেজি কী হবে, এগুলোতে রাহুল ছিল মাস্টার। এই আইপিএল-য়ে সেই প্ল্যানিংটা যেন আর একবার দেখতে পাচ্ছি। গত পাঁচটা টুর্নামেন্টে যা মিসিং ছিল।

• এ বারের রাহুল একটা অদ্ভুত কেয়ারফ্রি মনোভাব নিয়ে ক্রিকেট খেলছে। এই রাহুলের ‘মন্ত্র’ ‘কারও কাছে আর কিছু প্রমাণ করার দায় নেই আমার। কেউ আমার কাছে কিছু এক্সপেক্টও কোরো না। আমি শুধু মনের আনন্দে খেলে যেতে চাই’।
এই মনোভাবটা অনেকটাই তফাত করে দিচ্ছে...



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.