জঙ্গলমহল। শুনলেই চোখে ভাসে কেন্দু পাতা বা কাঠ কুড়িয়ে হাটে বিক্রির চেনা ছবি। জলের অভাব, যোগাযোগের অভাব, স্কুল-কলেজের অভাব। ব্যাঙ্ক, ডাকঘরও তেমন কই?
উন্নয়ন-বঞ্চিত বাঁকুড়ার এ হেন জঙ্গলমহল থেকেও মাসে দু’কোটি টাকা তুলতে চেয়েছিলেন সারদা-কর্ণধার সুদীপ্ত সেন। রাইপুর ব্লক সদরে সারদার গোষ্ঠীর অফিস থেকে মোটা টাকা উঠতে থাকায় এক বছরের মধ্যে পাশের সারেঙ্গা ব্লকেও ওই সারদা অফিস খুলেছিল। এজেন্টদের দাবি, ওই দুই ব্লক থেকে মাসে প্রায় এক কোটি ৩০ লক্ষ টাকার আমানত সংগ্রহ হত। কিন্তু, তাতেও সন্তুষ্ট ছিলেন না সারদার কর্ণধার। দুর্গাপুরে সংস্থার আঞ্চলিক অফিসের বৈঠকে সুদীপ্তবাবু এজেন্টদের আরও টাকা তোলার জন্য চাপ দিতেন।
২০১১ সালে রাইপুরে সারদার একটি অফিস চালু হয়। স্থানীয় মটগোদা এলাকার এক বাসিন্দা, যিনি অন্য এক লগ্নি সংস্থার এজেন্ট ছিলেন, তিনি সারদায় যোগ দেন। ওই এজেন্ট (আপাতত গা ঢাকা দেওয়া) ফোনে জানালেন, অনেক বাসিন্দা সারদায় লগ্নি করতে থাকেন। ইতিমধ্যে জঙ্গলমহলের স্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নয়নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্বোধন করা সারদার অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা চালু হয়। সারদার রাইপুরে অফিস খোলার পরে এজেন্ট ও আমানতকারীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকে। চাপ সামলাতে ২০১২ সালের জানুয়ারিতে সারেঙ্গায় আরও একটি শাখা অফিস খোলা হয়।” রাইপুরে ১ লক্ষ ৫৯ হাজার এবং সারেঙ্গায় ১ লক্ষ ৭ হাজার লোকের বাস। এজেন্টদের দাবি, প্রতি মাসে রাইপুরে প্রায় ৭০ লক্ষ আর সারেঙ্গায় প্রায় ৫০ লক্ষ টাকার ব্যবসা করত সারদা। এলাকায় তৃণমূলকর্মী হিসেবে পরিচিত সারদার এজেন্ট পার্থপ্রতিম গুঁই, আর এক এজেন্ট রাজেশ খান জানান, শুধু রাইপুরেই সংস্থার প্রায় ২৫০ জন এজেন্ট ও দু’হাজারের বেশি লগ্নিকারী ছিলেন। প্রতি মাসে ১০- ১২ হাজার টাকা রাখা আমানতকারীর সংখ্যা কম নয়।
সংস্থার অন্য এক এজেন্ট, রাইপুরেরই বাসিন্দা বিদ্যুৎকুমার গুঁইয়ের দাবি, “দু’বছরের বেশি সারদায় কাজ করেছি। প্রতি মাসে প্রায় ৮০ হাজার টাকার ব্যবসা দিতাম।” ব্যবসা এতটাই বাড়ছিল যে, মটগোদার ওই বড় এজেন্ট (যিনি মাসে কম করে দেড় লক্ষ টাকা কমিশন পেতেন বলে অন্য এজেন্টদের দাবি) সম্প্রতি রাইপুরে জমি কিনে দোতলা বাড়ি তৈরি করাচ্ছিলেন। মাস সাতেক আগে গাড়িও কিনেছেন। রেখেছেন চালক।
এজেন্টরা জানাচ্ছেন, গ্রাহক টানতে তাঁরা সারদার অ্যাম্বুল্যান্সে লেখা মুখ্যমন্ত্রীর নাম দেখাতেন। সারদায় টাকা রাখতে অনিচ্ছুক অনেক গ্রামবাসীকেই গাড়িতে চাপিয়ে দুর্গাপুরে সারদার এজেন্টদের সেমিনারে নিয়ে যাওয়া হত। সেখানে সারদার অন ্য অনুষ্ঠানে যাওয়া রাজ্যের মন্ত্রীদের ছবি দেখিয়ে ভরসা জোগানো হত। সেই জালেই আটকে গিয়েছেন সারেঙ্গার বেলটিকরি গ্রামের দিনমজুর সমীরণ মণ্ডল বা বড় চাষি সুধাকর মণ্ডলরা। সমীরণবাবুর মন্তব্য, “সারদার অনুষ্ঠানে মন্ত্রীদের ছবি দেখিয়ে এজেন্টরা বলত সারদা প্রায় সরকারি সংস্থা। এখানে টাকা রাখলে মার যাবে না। সে সব কথায় ভরসা করে বড্ড ভুল করেছি।”
সারদার রাইপুর শাখায় টাকা রাখতেন সারেঙ্গার বাসিন্দা, পেশায় দর্জি বকুল দাস। তাঁর কথায়, “মহাজনদের কাছে কাপড় ধার নিয়ে ব্যবসা করতাম। ব্যবসার টাকা বাড়িয়ে নেওয়ার জন্য মহাজনদের ধার শোধ না করে সারদায় টাকা রাখতাম। মাসে ১২ হাজার করে জমা দিতাম। আর টাকা ফেরতের আশা নেই।”
সারেঙ্গার এক এজেন্টের কথায়, “দুর্গাপুরে আমাদের সঙ্গে বৈঠকের ফাঁকে সুদীপ্ত সেন মাঝে মধ্যে ফোন হাতে কিছুটা দূরে চলে যেতেন। ফিরে এসে বলতেন, ‘সিএম’ (মুখ্যমন্ত্রী) খোঁজ নিচ্ছিলেন। কোম্পানির ও রকম ঠাঁটবাট দেখে আমরাও তা বিশ্বাস করেছিলাম। সুদীপ্তবাবু এই দুই ব্লক থেকে প্রতি মাসে ২ কোটি টাকা তোলার জন্য চাপ দিতেন। বলতেন, জঙ্গলমহলে মোবাইল স্বাস্থ্য পরিষেবা দিচ্ছি। তবু কেন টাকা উঠছে না?”
খাতড়ার বাসিন্দা, সারদার এজেন্ট বাবলু পণ্ডা বলছেন, “সেই সময় কথাগুলো শুনে ভাল লাগত। টাকা তোলার জন্য নতুন উদ্যমে নেমে পড়তাম। এখন বুঝতে পারছি, সবই ভাঁওতা ছিল! আর সর্বস্বান্ত হওয়া লগ্নিকারীরা আমাদের দুষছেন।” |