মাঠের বাইরে সারা দিন প্রচণ্ড উত্তেজক কামড়াকামড়ির পর মাঠের ভেতরের আইপিএল যুদ্ধটা যে এমন একপেশে, পানসে আর ম্যাদামারা হয়ে যাবে, কে জানত? কে জানত, টিম মালিকের অমর্যাদার বদলা নিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ টিম কুড়ি ওভার পর্যন্ত ব্যাট করতে পারবে না? কে জানত, সারা দিনের খান উপাখ্যানে ম্যাচ ঘিরে যাঁর উপস্থিতি একেবারে চাপা পড়ে গিয়েছিল, সেই সচিন তেন্ডুলকর ৪৮ রানের ও রকম একটা ইনিংস খেলবেন? গত বছর থেকে চলা শাহরুখ বনাম এমসিএ যদি আইপিএলে পানিপথের প্রথম যুদ্ধ হয়, আজকেরটা হওয়ার কথা ছিল দ্বিতীয়। কার্যত ওয়াংখেড়েতে যা ঘটল, তাকে যুদ্ধ বলার কোনও উপায় নেই।
সারা দিন অনেকে গবেষণা করে যাচ্ছিলেন, কোন ম্যাচটা বড় হয়ে গিয়ে কোনটাকে হারাবে শাহরুখের মাঠের বাইরের ম্যাচ, না গম্ভীরের মাঠের মধ্যের ম্যাচ? তাঁরা দেখলেন, এটা নিছকই হল ভারতের দু’প্রান্তে ঘটা দিনের দু’টো আইপিএল ম্যাচের মতো। কারও সঙ্গে কারও মিল নেই।
প্রাক্ ম্যাচ মারমার-কাটকাট পরিস্থিতিতে যা আন্দাজই করা যায়নি। ট্রাইডেন্ট হোটেলে এগারো তলার ঘর। মুম্বইয়ে এটাই টিম রুম কেকেআরের। প্রোজেক্টর টাঙাচ্ছেন আইটি বিশেষজ্ঞ। এখুনি টিম মিটিংয়ে শেষ বারের মতো সিডিটা চালিয়ে দেওয়া হবে।
পিছনে আছড়ে পড়ছে আরব সাগরের ঢেউ। কিন্তু মুম্বইয়ের সমুদ্র বলে কথা। সেই ঢেউয়ে মোটেও উঁচু হয়ে ঝাপটে আসা ব্যাপারটা নেই। যেটা ঘরের মধ্যে পাওয়া গেল কেকেআর মহাকর্তার কণ্ঠস্বরে, “কী ভেবেছে এরা। শাহরুখ খানকে নিয়ে যা খুশি তাই করবে!”
বেঙ্কি মাইসোরকে বেশ উত্তেজিতই দেখাচ্ছে তখন। সকাল থেকে দিনের কাণ্ডকারখানা যে ভাবে এগোচ্ছে, তিনি বেশ তাজ্জব। বললেন, “কী হাস্যকর ব্যাপার চলছে দেখুন। মনে করা যাক আইসল্যান্ড বলল, আমি কিছুতেই বেঙ্কি মাইসোরকে আমার দেশে ঢুকতেই দেব না। কিছুতেই দেব না। প্রয়োজনে ইমিগ্রেশনকে বলে রাখব। আরে বাবা সবার আগে তো খোঁজ নাও, মাইসোর আদৌ তোমার দেশে যেতে চেয়েছে কি না!” মহাকর্তা-সহ কেকেআর শিবির মঙ্গলবার রাতেও ভেবে পাচ্ছিল না, সকাল থেকে তাদের টিম মালিকের বিরুদ্ধে এই ধুয়োটা উঠল কী করে যে তিনি ওয়াংখেড়েতে ঢুকে পড়তে পারেন। আর যেনতেন প্রকারেণ তাঁকে থামাতে হবে।
কেকেআর টিমের ভেতর এই মুহূর্তে নানান অন্তর্দ্বন্দ্ব। ক্রমাগত হারতে হারতে একটা টিমের ওপর চাপ তৈরি হয়ে যেমন একের পর এক কঙ্কাল বার হতে থাকে, গম্ভীরের দলেরও তাই। মাঠের জন্য নির্বাচিত পনেরো জনের দলে না থাকা মনোজ তিওয়ারির টুইট টিমের সেই পোড়া জায়গাটাই বার করে এনেছে। কিন্তু দুপুর-দুপুর টিভি চ্যানেলে যখন দেখানো শুরু হয়, স্থানীয় থানাকে এমসিএ বলেছে শাহরুখকে ওয়াংখেড়েতে ঢুকতে না দিতে, তখন গোটা টিম উত্তেজিত হয়ে পড়ে। এটা হচ্ছেটা কী এসআরকে কি ক্রিমিন্যাল নাকি যে এ ভাবে তাঁকে অপমান করা হবে?
এ দিন সকাল থেকেই এসআরকে নিয়ে এমন চাপা উত্তেজনা যে, বোঝাই যাচ্ছিল আসল আইপিএল প্রতিদ্বন্দ্বিতা এটাই মুম্বই ক্রিকেট সংস্থা বনাম এসআরকে। সোমবার এই শহরে রটে গিয়েছিল, শাহরুখ আদালতে গিয়ে এমসিএ-র সিদ্ধান্তে স্থগিতাদেশ নেবেন বলে ঠিক করেছেন। তার পরই হঠাৎ অনমনীয় হয়ে পড়ে মুম্বই সংস্থা। দুপুরে মহারাষ্ট্র প্রদেশ কংগ্রেস সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়েছে। রাজ ঠাকরে অবধি কড়া ভাষায় বলেছেন, যা হয়ে গিয়েছে, হয়ে গিয়েছে। তার পরেও জরুরি সভা অবধি ডাকার প্রয়োজন মনে করেনি ক্রিকেট সংস্থা। |
ওয়াংখেড়ের গ্যালারিতে তিনি না থেকেও আছেন। ছবি: বিসিসিআই। |
প্রেসিডেন্ট রবি সবন্ত আনন্দবাজারকে বললেন, এত তাড়াহুড়ো করার কী
আছে? মিটিং হলে পরে হবে। এটা কি জাতীয় সমস্যা নাকি? এমসিএ তখন এমনই একজোট যে তাদের বিরোধীরা পর্যন্ত শাহরুখের সমর্থনে কিছু বলছেন না। এমন কোনও পরিস্থিতি হচ্ছে না যে, সংস্থার ভেতর থেকে বিক্ষোভ তৈরি হবে। উল্টো চাপে পড়বেন রবি সবন্ত। আগামী জুলাইতে এমসিএ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যিনি রবির বিরুদ্ধে প্রার্থী, সেই দিলীপ বেঙ্গসরকর পুণে থেকে ফোনে বললেন, “এরা কিন্তু অনড় যে শাহরুখ সে দিন খুব অসভ্যতা করেছিল। আমি আর কী বলব।” বিরোধী গোষ্ঠীর আর এক মুখপাত্র মিলিন্দ রেগে বললেন, “শাহরুখও তো দুঃখপ্রকাশ করে একটা চিঠি দিতে পারত। দু’পক্ষই যদি ইগো নিয়ে বসে থাকে, তো মুশকিল।”
দুপুরে তখন গোটা মুম্বই ফেটে পড়ছে এই ইস্যু নিয়ে। কিন্তু যাঁকে ঘিরে এত কাণ্ড, তিনি কোথায়? মন্নতের বাইরেটা আর পাঁচ দিনের মতোই। জানা গেল ভেতরে ডিসকভারি চ্যানেলের জন্য ডকুমেন্টারি শু্যট করছেন শাহরুখ। যেহেতু ওয়াংখেড়ে যাবেন না, হাতে অনেক সময়। আর এই তথ্যচিত্রের বিষয়ও কেকেআর। ব্যর্থতা থেকে আইপিএল চ্যাম্পিয়নের সিংহাসনে আরোহণ।
তখন নাইটদেরও কেউ জানেন না যে, আজ শাহরুখ তারই মধ্যে শহরের অন্য প্রান্তে টিম হোটেলে উদয় হবেন জুহি চাওলা আর জয় মেটাকে নিয়ে! ইতিমধ্যে এসআরকে পক্ষ তীব্র রোষে ফেটে পড়ছে আইপিএল কমিটি এবং মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের ওপর। কেউ কেউ বললেন, আইপিএল থেকে প্রত্যেক রাজ্য সংস্থা বছরে পঁচিশ কোটি টাকা করে পায়। কী করে রাজ্য সংস্থা সাহস পায় সেই আইপিএলের সেন্টিমেন্ট অগ্রাহ্য করার? ভারতীয় বোর্ডই বা সব কিছু দেখেশুনে হাত গুটিয়ে বসে রয়েছে কেন? কারও কারও মনে হচ্ছিল, মুম্বই ইন্ডিয়ান্স তো আসল উদ্যোক্তা। এই দু’মাস ওয়াংখেড়ে মাঠ তো তাদের অধীনে। তারা গোটা ইস্যুতে কিছু বলছে না কেন? বেঙ্কি মাইসোর হতাশ ভাবে বলে ফেললেন, “বেশ রহস্যজনক হয়ে পড়েছে ব্যাপারটা। হুইলস উইদিন হুইলস।”
আনন্দবাজার থেকে যোগযোগ করা হলে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের এক মুখপাত্র বললেন, “গোটা ব্যাপারটায় আমাদের নো কমেন্ট। সেই গত বছর থেকেই।” কিন্তু কেন? অম্বানীদের সঙ্গে তো শোনা যায় সামাজিক পর্যায়ে শাহরুখের যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা। “সেটা ঠিক। কিন্তু এই ইস্যুতে আমাদের নো কমেন্ট। আমরা এর মধ্যে নাক গলানোর কে?” বললেন মুখপাত্রটি।
এমনিতেও যে মুম্বইয়ের মাঠে সেই প্রথম বছরের তিক্ত অভিজ্ঞতার পর আর কখনও খেলা দেখতে উৎসাহ প্রকাশ করেননি শাহরুখ, ক্রিকেটমহলে সবার জানা। আজও সেই সিদ্ধান্ত বদলানোর কারণ ঘটেনি। যেহেতু প্রথম বছর তাঁকে প্রভূত টিটকিরির শিকার হতে হয়েছিল।
এ দিন টিম রওনা হওয়ার মিনিট পনেরো আগে শাহরুখ অতর্কিতে হোটেলে ঢোকেন। টিমকে পেপ টকও দিয়ে যান। হোটেল থেকে যখন রাত্তির ন’টা নাগাদ বার হন, তখন তেন্ডুলকরের উইকেটটা পড়েছে। সেখান থেকে চলে যান জুহুতে অভিনেতা ধর্মেন্দ্রর পার্টিতে। ভেবেছিলেন, ম্যাচের পর রাত্তিরে আবার ফিরবেন। লজ্জাকর এই হারের পর রাত্তির একটা অবধি টিম হোটেলে আর তাঁকে ফিরতে দেখা যায়নি।
অথচ মুম্বইয়ে জিততেই তিনি বরাবর সবচেয়ে আগ্রহ দেখিয়েছেন। এখন আর টিমকে এসএমএস করেন না। যোগাযোগও অনেক কমিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু প্রথম বছর সৌরভদের লিখেছিলেন, ‘কোনও দিন তোমাদের কাছে কিছু চাইনি। আজ চাইছি। এই মুম্বই শহরটায় লোকে আমাকে কিং বলে। এখানে ম্যাচটা জিতে দাও।’ সেই ম্যাচটা কেকেআর যাচ্ছেতাই হেরেছিল।
মঙ্গলবারের ম্যাচটাও যা-তা হেরে আইপিএল চ্যাম্পিয়নরা কার্যত দীনহীন প্রজার বিদায় নিল। শাহরুখ সামনে থেকে দেখলেন না। হয়তো একান্তে খুশিই হলেন। রবি সবন্তরা যে নিষেধাজ্ঞা তোলেননি, নইলে মাঠে বসে দেখতে হত, ১৮ ওভারে টিম অল আউট হয়ে যাওয়ার লাঞ্ছনা। এই শহরে না লোকে তাঁকে কিং বলে!
|