‘পথের পাঁচালী’ বললেই আমাদের স্মৃতিতে ১৯৫৫ সালটা ভেসে ওঠে। কিন্তু আমাদের খেয়াল থাকে না যে তার কত আগে থেকেই সত্যজিৎ তোড়জোড় শুরু করেছিলেন এ-ছবি বানানোর।
সত্যজিতের ছবি বললেই হয়তো আমাদের মনে পড়ে যায়, রাজস্থানের কেল্লা বা বারাণসীর ঘাট-অলিগলি। কিন্তু কত বার কত ভাবে যে বাংলার আনাচ-কানাচ ফিরে এসেছে তাঁর ছবিতে, তা খেয়ালেই আসে না।
ষাট বছর আগে, ১৯৫২-র অক্টোবরে এক রোববার সত্যজিৎ তাঁর ফিল্মের দলবল আর দু’টি শিশু উমা দাশগুপ্ত আর সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে ‘পথের পাঁচালী’র লোকেশনের দিকে রওনা হন। ঠিক করেছিলেন, প্রথম দিনে শুধুই লম্বা কাশফুলের জঙ্গলে টেলিগ্রাফের খুঁটি আর ওই অপু-দুর্গার দৃশ্যটা তোলা হবে।
তোলা হয়েওছিল। তবে শিশু সুবীরকে স্বাভাবিক অভিনয় করানোর জন্যে সত্যজিৎ কাশবনের মধ্যে এ-দিকে ও-দিকে খানিক-খানিক দূরত্বে ইউনিটের লোকজনকে দাঁড় করিয়ে দেন। তাঁরা একটু পরপরই সুবীরের নাম ধরে ডাকতে থাকেন। সুবীরও সেই ডাকগুলো শুনে এ-দিক ও-দিক তাকাচ্ছেন। তাঁর হাঁটার পথে কয়েকটা শুকনো ডালও ফেলে রাখা হয়েছিল, যেগুলি তাঁকে লাফিয়ে পার হতে হয়। |
এ-দৃশ্যটাই পরে আমরা কী ভাবে দেখি ‘পথের পাঁচালী’তে? দেখি যে, দুর্গার খোঁজ করতে-করতে এ-দিক ও-দিক তাকাতে তাকাতে অনিশ্চিত ভাবে পা ফেলে অপু সামনে এগোচ্ছে। একটা বাচ্চা ছেলেকে কী ভাবে অভিনয় করিয়ে নিতে হয় তা প্রথম দিনেই আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন সত্যজিৎ রায়। লিখছেন: ‘পথের পাঁচালী তুলতে-তুলতে, এই রকমের নানা কৌশল আমাকে খাটাতে হয়েছে।’ ২. নিজেকেও কত কী শিখতে হয়েছিল। বোড়াল গ্রামটাকে তখন বিভূতিভূষণের নিশ্চিন্দিপুর বানিয়ে শুটিং করছেন। চুনিবালা আর এক শিশু অভিনেত্রী রুন্কি বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে। দৃশ্যটা এরকম: ইন্দির ঠাকরুণ বারান্দায় বসে বাঁশের খুঁটিতে ঠেস দিয়ে দুধে-ভেজানো মুড়ি খাচ্ছেন, আর দুর্গা দু’হাতে একটা রুপোলি রঙের ফিতে আস্তে আস্তে জড়াচ্ছে খুলছে এবং ইন্দির ঠাকরুণের খাওয়া দেখছে। শটটা এত ভাল ভাবে উতরে যায় যে ক্যামেরা বন্ধ করতেও ভুলে যান সত্যজিৎ, সেটা যেমন চলছিল তেমন চলতেই থাকে। বংশী চন্দ্রগুপ্ত, ‘পথের পাঁচালী’র শিল্প-নির্দেশক, বন্ধুও সত্যজিতের তাঁকে ডাকনামে ডাকেন ‘মানিক’, দূর থেকে সেটা লক্ষ করে চেঁচিয়ে ওঠেন: “কী হল মানিক? ‘কাট’ বলো!” ৩. বিভূতিভূষণের ‘অপরাজিত’ করার সময়ে সর্বজয়ার জ্যাঠামশাই ভবতারণের চরিত্রে এক বৃদ্ধকে খুঁজে পেয়েছিলেন সত্যজিৎ, অপেশাদার অভিনেতা বা অনভিনেতা রমণীরঞ্জন সেন। ছোট অপুর চরিত্রে পিনাকী সেনগুপ্ত।
মনসাপোতায় ভবতারণের সঙ্গে সর্বজয়া-অপুর নানা দৃশ্য, বোড়ালেরই কাছাকাছি আর-একটা গ্রামে শুটিং। একদিন রাতে একটা খাওয়ার দৃশ্য, দাওয়ায় বসে। সর্বজয়া হাতপাখা নিয়ে বাতাস করবেন, ভবতারণ খেতে-খেতে কথা বলবেন, আর তাঁর কথা শেষ হওয়ার আগেই অপু গেলাস তুলে জলে চুমুক দেবে। শট নেওয়া শুরু হয়েছে, সব ঠিকঠাক এগোচ্ছে, হঠাৎ কথা শেষ করেই রমণীরঞ্জন তাঁর বাঁ হাতের তর্জনী দিয়ে অপুর কোমরে একটা খোঁচা মারলেন। সত্যজিৎ তো থ! ক্যামেরা বন্ধ করে বললেন ‘দাদু, ও কী করলেন, ওকে আঙুল দিয়ে অমন করলেন কেন?’ রমণীবাবুর নির্লিপ্ত উত্তর: ‘অর জল খাওনের কথা না এইখানে? পোলাপান, যদি ভুইলা যায়?’
অনভিনেতা হয়েও রমণীরঞ্জন নিজে কিন্তু আশ্চর্য অভিনয় করেছিলেন। সকৃতজ্ঞ ভাবে সত্যজিৎ তাঁর কাছে গিয়ে বলেছিলেন: ‘দাদু... আপনার কাজ সত্যিই ভালো হয়েছে।’ সত্যজিতের দিকে না ফিরেই ফের গম্ভীর গলায় বৃদ্ধের উত্তর: ‘বলি, খারাপডা হইল কবে?’ |