|
|
|
|
হুল্লোড় |
রবীন্দ্রসঙ্গীতে সুর পালটে কথা জুড়ে খবরদারি কেন |
রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। থাকেন ওপার বাংলায়। কিন্তু এপার
বাংলাও তাঁর গানে মুগ্ধ। কথা বললেন স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায় |
শান্তিনিকেতনে গান শেখাটা কেমন ছিল? শান্তিনিকেতনের সঙ্গীত শিক্ষা আমার জীবনটাকেই বদলে দিয়েছিল। তখন কলকাতার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না। আর ঢাকাতেও আমি খুব নিয়ম করে গান শিখতাম না। শান্তিনিকেতনে প্রথম রবীন্দ্রনাথকে চিনলাম। যাঁরা গুরুদেবের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন, তাঁদের আমি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম। তখন থেকেই গান নিয়ে আলাদা করে ভাবতে শুরু করি। এই সময় থেকেই রাবীন্দ্রিক ভাবনা আমার জীবনের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল।
আপনি নিজে কি রাবীন্দ্রিক? রাবীন্দ্রিক মানেই ঢাকাই শাড়ি, চুলে ফুল আর কপালে টিপ আপনি কি এটা মনে করেন? আমি রাবীন্দ্রিক বলাটা ভুল। আসলে রাবীন্দ্রিক বলতে আমি কী বুঝি সেটা আগে বলি। আমার কাজে, চিন্তায়, আচরণে রবীন্দ্রনাথের যে প্রভাব, সেটাই আমার কাছে রাবীন্দ্রিক। রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে যা কিছু আমার জীবনে এসেছে তাই আমার কাছে রাবীন্দ্রিক। ঢাকাই শাড়ি, ফুল আর কপালে টিপ নিয়ে কোনও রাবীন্দ্রিক ইমেজ তৈরি করা যায় বলে আমি মনে করি না।
তা হলে হল্টার বা জিনস্ পরে যদি কেউ রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়, তাতে কি আপনি আপত্তি করবেন? এখন মিউজিক ব্যাপারটাই পুরোপুরি ভিস্যুয়াল হয়ে গিয়েছে। সময়ের খাতিরে রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়ার ধারাও বদলেছে। আগে কনক দাস বা অমিয়া ঠাকুর যে ভাবে গান গাইতেন, আমরা কি সেই স্টাইলে আজ গান করি? করি না। দশ বছর বাদে এই গানের ধারা আরও পাল্টাবে। নয়তো রবীন্দ্রনাথের কথায় বলতে হয় তা ‘মৃতসঙ্গীত’-এ পরিণত হবে। তো সেই জায়গা থেকে কেউ জিনস্ বা হল্টার পরে যদি রবীন্দ্রনাথের গানকে গানের মতো করেই গাইতে পারে, তাতে আপত্তি কোথায়? এখানে কতগুলো বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি। দ্যাখো, আমি যদি ভাবি আমি হল্টার আর জিনস্ পরে গান করছি কেবল নতুন কিছু করে তাক লাগিয়ে দেওয়ার জন্যে, তা হলে সেটা খুব ভুল হবে। কিন্তু একজন কলেজে পড়া মেয়ে যখন গানের মধ্যে ঢুকে গানটা গাইছে। তখন সে শাড়ি পরল না জিনস্ পরল, তাতে কিছু এসে যায় না। কেননা গান না বুঝে শাড়ি পরে গাইলেও কোনও লাভ নেই। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে আমার সাজ বা শরীরের ভাষা যেন কখনও আমার গানকে ছাপিয়ে না যায়।
আপনি বলছেন মিউজিক এখন ভিস্যুয়াল হয়ে গেছে ইউ টিউবে। আপনার অজস্র গানের হাজার হাজার লাইক বাটন-ও সেই কথাই বলে। কিন্তু বাংলা সিনেমায় যেখানে এখন রবীন্দ্রনাথের গানের ব্যবহার এত বেড়ে গিয়েছে, সেখানে আপনার গান নেই কেন? তাই বুঝি? বাংলা ছবিতে এখন অনেক বেশি রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার করা হয়? ও! আসলে সে ভাবে আমায় কেউ গাইতে ডাকেনি। আর আমি তো কলকাতায় থাকি না, তাই সে ভাবে হয়তো কেউ ডাকতে পারে না। প্রস্তাব এলে নিশ্চয়ই গাইব। |
|
রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা |
ইদানীং রবীন্দ্রনাথের গানকে যাঁরা পেশা করছেন বা করতে চাইছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে একটা প্যাকেজের কথা বলা হয়ে থাকে। এই প্যাকেজে শিল্পীর সৌন্দর্য, স্থায়ী মুগ্ধ প্রযোজক, কর্মঠ পি. আর, কম সময়ে গুচ্ছ গুচ্ছ অনুষ্ঠান আর অ্যালবাম প্রকাশের শর্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়। আপনার শিল্পী হয়ে ওঠার পথে এ রকম কিছু ছিল কী? আমি একেবারেই এই ধারার সঙ্গে পরিচিত না। প্রথমেই বলি, রবীন্দ্রনাথের গানকে চাইলেই পেশা করা যায় না। আমি গান গাইতে আরম্ভ করলাম। আর সেটা আমার পেশা হয়ে গেল। তা কিন্তু একেবারেই না। দ্বিতীয়ত ভাগ্য লাগে। আমি খুব ভাল গাইলেই যে আমার নাম হবে তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নয়। তবে এই পি. আর, মুগ্ধ প্রযোজকের পেছনে ছুটতে গিয়ে আমি দেখি অনেকেরই গানের মানটা পড়ে যাচ্ছে। আমার গুরু কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় বলতেন ‘তোমাকে না হয় গাছের ডালে তুলে দেওয়া গেল, কিন্তু ডাল ধরে বসে থাকার ক্ষমতা তোমার থাকা চাই নয়তো পরে যাবে’। এই বসে থাকার ক্ষমতা অনুষ্ঠান, প্রযোজক দিয়ে কখনওই হবে না, এর জন্যে প্রয়োজন কেবলমাত্র সাধনা। অন্তত আমার জীবন দিয়ে আমি এটাই জেনেছি।
সাধনার সঙ্গে সঙ্গে গানের ক্ষেত্রে গ্রামারটা কতখানি জরুরি? গান কখনই গ্রামার দিয়ে হয় না। এমন একজন যিনি হয়তো গ্রামার মেনে গাইছেন না, সুন্দরীও না, কণ্ঠস্বরও খুব চাঁচাছোলা নয়, কিন্তু এমন গাইলেন কোথাও একটা হঠাৎ করেই ভিতরে ঘা দিয়ে গেল। কেমন করে হল তা বলা মুশকিল! কিন্তু এরকমটাই হয়। ভিতর থেকে গাইতে গাইতে শ্রোতার ভিতরে ঢুকে যাওয়া।
এক সময়ে আপনার গানের ক্ষেত্রে বলা হত, আপনি কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অনুকরণ করেন। এটা কি ঠিক? যখন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে গান শিখতে আরম্ভ করি তখন আমার বয়স খুবই কম ছিল। ওই সময়ে গুরুর মতো করেই গান গাইতে চাইতাম, সেটা প্রথম পর্যায়ে খুব স্বাভাবিক। নয়তো গানটা এত ভাল করে শিখতে পারতাম না। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় যদিও সব সময় বলতেন আমার গলাকে নকল করে কখনও সরু, রিনরিনে গলায় গান গাইবে না। আমার ভাবনা, থ্রোয়িং এগুলোকে বুঝে অনুসরণ করো। ওই ট্রেনিংটা এত ভাল হয়েছিল যে আজ কোনও নতুন গান তুললে মোহরদি কোন শব্দটা কী ভাবে বলতেন সেটা আমি বুঝতে পারি। পরবর্তী কালে বয়স এবং অভিজ্ঞতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গানকে আমার মতো করে নিজস্ব ভাবনা দিয়ে পরিবেশন করতে শিখেছি। আমার নিজের গায়কি তৈরি হয়েছে। তবে কখনওই কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলা নকল করিনি। কারণ যিনি কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলায় গান শুনবেন তিনি সর্বদাই কণিকাদির গানটাই শুনবেন, আমারটা কেন শুনবেন?
যুক্তরাষ্ট্র, বাংলাদেশ, কলকাতা, এই তিন জায়গায় আপনি সমান তালে গান গাইছেন এবং শেখাচ্ছেন। নতুন প্রজন্ম আজকের সময়ে রবীন্দ্রনাথের গানকে কেমন ভাবে চাইছে বলে আপনার মনে হয়? কলকাতা এবং বাংলাদেশে নতুন প্রজন্ম রবীন্দ্রনাথের গান শিখছে, তাদের নিষ্ঠারও কমতি নেই। কিন্তু বিদেশে নতুন প্রজন্ম রবীন্দ্রনাথের গানই শুধু নয় বাংলা ভাষাতেই আর তেমন আগ্রহী নয় বিদেশে ওয়ার্কশপ করতে গিয়ে দেখেছি এখান থেকে বিয়ে হয়ে গিয়েছেন কেউ, প্রথম বা দ্বিতীয় জেনারেশনের মধ্যেই গান চর্চা সীমিত থাকছে। তার বেশি কিছু না। বরং যেটা বলার মতো, সেটা হল বিদেশিরা রবীন্দ্রনাথের গানে খুবই আগ্রহী। বাংলাতেই গান গাইছেন। তার আবার খুব ভাল অনুবাদ-ও হচ্ছে। যার ফলে বাংলা ভাষা না জেনেও শ্রোতা এবং শিল্পী রবীন্দ্রগানের কাব্যরস থেকে বঞ্চিত হচ্ছে না।
নতুন প্রজন্মের মধ্যে আপনি সোমলতার গান শুনেছেন? (একটু ভেবে) একটা বোধহয় শুনেছি মায়াবনবিহারিণী।
কেমন লেগেছে আপনার? (বেশ খানিকটা সময় নিয়ে) নাহ্! সোমলতা ‘মায়াবনবিহারিণী’ গানটা যে ভাবে গেয়েছে সেটা খুবই আপত্তিকর। দ্যাখো, ওর গলাটা খুব সুন্দর সুরে বলে। আর সেখানেই আমার আপত্তি, এত ট্যালেন্টেড একজন গায়িকা রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে কেন এ রকম এক্সপেরিমেন্ট করবে? নিজের গান নিয়ে করুক না যেমন ব্যান্ডের ছেলেমেয়েরা করে।
এই যে আপনি বললেন সময়ের সঙ্গে বদলাতে হবে। সোমলতা তো নিজের মতো করে গানটি গেয়েছে। কেউ নিজের মতো করে রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে পারবে না? একটা জিনিস কিন্তু আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যেটা রবীন্দ্রনাথ বার বার বলেছেন যে, তাঁর গানে কিন্তু তিনি কিছু কমতি রাখেননি যে অন্য কেউ এসে সেখানে ভরাট করবে। আমার আরও খারাপ লেগেছে কলকাতার রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞরা কেউ কেন কিছু বললেন না এই নিয়ে? এটা যদি বাংলাদেশ হত তা হলে কেস করে এই গান বন্ধ করে দেওয়া হত। এখানে কিছু হল না দেখে আমি খুব দুঃখ পেয়েছি। গানটাকে গানের মতো রেখে কেউ নিজের মতো করে গাক না, সুর পাল্টে কথা জুড়ে গানের ওপর খবরদারি করে গান গাওয়ার কথা আমি কখনওই বলিনি।
বাংলাদেশের কথা ফিরে ফিরেই আসছে, সেই প্রসঙ্গে জানতে ইচ্ছে করছে বাংলাদেশের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে কি রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়া যায়? আমাদের কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠানেই গান গাওয়ার চল নেই। সেই জন্যে সে ভাবে রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তবে অন্য যে কোনও সামাজিক অনুষ্ঠান, একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে নববর্ষ, রবীন্দ্রনাথের গান ছাড়া ভাবতেই পারি না।
গীতবিতান কালানুক্রমিক হলে কি আপনার মনে হয় বেশি সুবিধা হবে? না। কালানুক্রমিক হলে সেটা থিম্যাটিকাল হবে না। যখন কেউ গান করবেন বা পড়বেন সেখানে পর্যায় ধরে যদি গানগুলো সাজানো থাকে অনেক বেশি সুবিধা হবে। কালানুক্রমিক গীতবিতান গবেষণা বা কোনও শিল্পীর গান সম্পর্কে তথ্যের জন্যে দরকার।
রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে নিজেকে কত নম্বর দেবেন? নিজের কাছে আপনার প্রত্যাশাই বা কতখানি? নম্বর দেওয়ার তো প্রশ্নই নেই। তবে রবীন্দ্রনাথের কথায় এটুকু বলতে পারি ‘হেথা যে গান গাইতে আসা আমার হয়নি সে গান গাওয়া’। এখনও সে ভাবে সেই পারফেকশন নিয়ে গান গাওয়া আমার হয়নি। তবে গান নিয়ে সম্প্রতি সার্ধশতবর্ষে ‘শ্রুতি গীতবিতান’ নাম দিয়ে তিরিশটি ডিভিডি-র একটি সংকলন প্রকাশ করেছি। এতে রবীন্দ্রনাথের সুর পাওয়া যায় এমন সমস্ত গান রেকর্ড করা হয়েছে। বাংলাদেশের শিল্পীরাই রেকর্ড করেছেন। এবং বাংলাদেশের কিছু পুরনো শিল্পীর রেকর্ডিং-ও এতে সংরক্ষণ করা হয়েছে, যাতে নতুন প্রজন্ম ওই শিল্পীদের গান শুনতে পান।
ভবিষ্যতে নিজের জন্যে কিছু কাজ করার পরিকল্পনা আছে? রবীন্দ্রনাথের গানের কথার সঙ্গে এখনকার বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতের মেঠো গানের কথা, ভাবনার অনেক মিল খুঁজে পাই। সে রকম কিছু গান গাওয়ার ইচ্ছে আছে আমার। পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের সেই গানগুলোও থাকবে যেখানে নিজের মধ্যে নিজেকে নতুন করে পাওয়ার কথা বলা আছে। এই চিন্তাটা আজকাল খুব মনে ঘুরছে।
কেন? আপনিও কি নিজেকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন? নিজের ভিতরকার আমিকে খুঁজে বেড়ানো, নিজেকে জানার মধ্যেই দিয়েই তো জীবন বয়ে যায়। আমি তো আর ব্যতিক্রম নই। আমিও খুঁজছি নিজেকে গানের মধ্যে। |
|
|
|
|
|