বছর বছর কমতে থাকা কমিশনের জেরেই ডাকঘরের এজেন্সি ছেড়েছিলেন ওঁরা। মোটা কমিশনের হাতছানিতে বেছে নিয়েছিলেন সারদার মতো নানা অর্থলগ্নি সংস্থা। তাঁদের সঙ্গেই ডাকঘর-বিমুখ হয়েছিলেন আমানতকারীরাও। কিন্তু সেই দুর্দিনেও ডাকঘর ছেড়ে যাননি বেহালার সরস্বতী চৌধুরী, যাঁকে মধ্য কলকাতায় অফিসপাড়ায় অনেকেই চেনেন ‘সরস্বতীদি’ হিসেবে।
সারদা কাণ্ডের পর যেখানে বারবার ডাকঘর-স্বল্প সঞ্চয়ের বেহাল দশার কথা উঠে এসেছে, সেখানে সরস্বতীদির ডাকঘর আঁকড়ে থাকার গল্পটা নেহাতই ব্যতিক্রম। এবং একই সঙ্গে সরকারি ব্যবস্থার প্রতি আস্থারও উদাহরণ। গত কয়েক বছরে একাধিক বার নানা জনের কাছ থেকে বিভিন্ন অর্থলগ্নি সংস্থায় এজেন্ট হিসেবে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব পেয়েছিলেন সরস্বতীদি। কিন্তু সহকর্মীদের বেশ কয়েক জন ডাকঘর ছেড়ে চলে গেলেও “সরকারি দফতর থেকে টাকা মার যায় না” এই স্লোগানে আস্থা রেখে ও-পথ মাড়াননি তিনি। এই কথা বুঝিয়েছেন আমানতকারীদেরও।
গত কয়েক দিনে বারবারই উঠে এসেছে ডাকঘরে আমানত কমে যাওয়ার কথা। কম সুদে টাকা জমা রাখা এবং নানা ধরনের কাগজপত্রের বায়নাক্কায় সাধারণ মানুষ মুখ ফিরিয়েছেন ডাকঘরের সঞ্চয় থেকে। একই ভাবে কমেছে এজেন্টদের কাজ-ও। সরস্বতীদেবী বলছেন, “১৯৭৮-৭৯ সালে কিছুটা পেটের তাগিদেই ডাকঘরের এজেন্সি নেওয়া। তার পর থেকে চলছে।” সে সময় ভালই ছিল এজেন্টদের আয়। কিন্তু গত দশকের মাঝামাঝি থেকে তা কমতে শুরু করে। এখন এসে ঠেকেছে যৎসামান্য পরিমাণে। কী রকম? |
সরস্বতীদেবী বলছেন, “এক সময় প্রতি হাজার টাকায় ২৫ টাকা কমিশন পেতাম আমরা। এখন কমতে কমতে তা প্রতি হাজার টাকায় ৫০ পয়সায় এসে ঠেকেছে। এ ভাবে কি চলে বলুন!” অথচ, তরুণী মেয়ে ও বৃদ্ধা মাকে নিয়ে তিন জনের সংসার এই কমিশনের আয়েই চালাতে হয় তাঁকে। কয়েক বছর আগেও বার্ষিক লাখ দুয়েক টাকা আয় ছিল সরস্বতীদির। এখন তা কমতে কমতে বার্ষিক এক লাখ টাকার নীচে এসে দাঁড়িয়েছে। অথচ ডাকঘর ছেড়ে বিভিন্ন অর্থলগ্নি সংস্থায় চলে যাওয়া এজেন্টরা কমিশন পেতেন শতকরা ২৫-৩০ টাকাও। স্বাভাবিক ভাবেই আমানতকারীদের পরিমাণের উপরে আয়ের অঙ্কটা মাসে লাখ টাকা ছুঁয়েছিল অনেকেরই।
ইচ্ছে করলে এমন আয় তো সরস্বতীদিরও হতে পারত। ডাকঘরের এই আকালের দিনেও যার ৫০-৬০ জন আমানতকারী রয়েছেন। কিন্তু হাজারো কথাতেও অর্থলগ্নি সংস্থার কাজে রাজি হননি তিনি। সরস্বতীদেবী বলছেন, “বয়স হয়েছে, তার উপরে অত কিছু আমি বুঝি না ভাই। তা ছাড়া অল্প বয়স থেকে শুনে এসেছি, সরকারি টাকা মার যায় না। আমানতকারীদেরও একই কথা বলেছি। জানি, এ ভাবেই ডাল-ভাত, নুন-ভাত ঠিক জুটে যাবে।”
তবে ইদানীং যে অনেক এজেন্ট ডাকঘরের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও কাজে উৎসাহ পাচ্ছেন না, সে কথাও মেনে নিয়েছেন দীর্ঘ দিনের এই এজেন্ট। সরস্বতীদেবীর কথায়, “রাস্তায় বেরোলে তো চা-মুড়ি খাওয়ারও খরচা আছে। টাকাটাই বা আসবে কোথা থেকে!” এখনও লোকে ডাকলে ছুটে যান। কিন্তু এ ভাবে আর কত দিন টানবেন, বুঝতে পারছেন না পার্ক
স্ট্রিট ডাকঘরের ‘এজেন্ট দিদি’। শুনেছেন, ডাকঘরের আধুনিকীকরণ হচ্ছে। কিন্তু কমিশন বাড়বে কি না, এখনও জানেন না।
তা হলে কি ভবিষ্যতে অন্য কোনও সংস্থার এজেন্সি নিতে পারেন ‘সরস্বতীদি’? বললেন, “না। অনেক দিন তো এ ভাবেই কেটে গেল। আর যে ক’দিন বাঁচব, ডাকঘরের এজেন্সি-ই চালিয়ে যাব।” |