|
|
|
|
দাদার সঙ্গে কেকেআর গ্যালারিতে |
ঠিক এক বছর আগের এই দিন কাগজ ভর্তি ছিল খান বনাম দাদা দ্বৈরথ নিয়ে।
আজ সবাই খেলছেন!
সচিন। রাহুল। গিলক্রিস্ট। শুধু তিনি কিনা গ্যালারিতে
কেকেআর ম্যাচের দর্শক হয়ে বসা। লিখছেন সহদর্শক অনিলাভ চট্টোপাধ্যায় |
ওই একবারই চোখটা চিকচিক করে উঠতে দেখলাম। “ম্যাচ শেষে আমি আর শাহরুখ যখন একসঙ্গে ইডেন গ্যালারির পাশ দিয়ে হাঁটছি, শাহরুখ তখন বলেছিল, ‘দাদা এত ভালবাসা আমি আগে কারও জন্য দেখিনি। তুমি সত্যিই খুব লাকি।’” বলেই চুপ। শান্ত চোখ দুটো ইডেন গ্যালারির দিকে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজছিল। যা খুঁজছিল সেটা অবশ্য কেউ কোনও দিন ফিরে পায় না—ফেলে আসা সময়!
সময়ের রিওয়াইন্ডে আমিও তখন ৫ মে: ২০১২-এ। ওই তো একে অপরের দিকে এগিয়ে গেলেন শাহরুখ খান আর সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। একসঙ্গে হাঁটতে শুরু করলেন। এগিয়ে গেলেন একেবারে গ্যালারির দিকে। গোটা ইডেন তখন উত্তাল ‘দাদা, দাদা’ চিৎকারে। একটা মানুষকে ঘিরে ভালবাসা, উন্মাদনা যে এ ভাবে গণ-হিস্টিরিয়ার চেহারা নিতে পারে, ৫ মে ২০১২র আগে কে জানত! এক বছর পর আমিও ফিরে ফিরে ভাবছিলাম! ইডেনের লোয়ার টিয়ারে তখন দাদা স্বয়ং পাশে বসাা— সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়!
তিনশো বছরের পুরনো একটা শহরের মানুষের বেঁচে থাকা, আত্মপরিচয়, গর্ববোধ সব ছাপিয়ে সেই শহরেরই এক মানুষের উপস্থিতি, তাঁকে ঘিরে মানুষের সমর্থন। কে জানে, পৃথিবীর অন্য কোনও শহর দেখেছে কি না। নিজের শহরের সেরা সন্তানের জন্য গর্ববোধ পৃথিবীর সর্বত্র থাকে। লিওনেল মেসি বাবা হলে তাঁর সদ্যোজাত সন্তানের জন্য তড়িঘড়ি মেম্বারশিপ বুক হয়ে যায়, কিটস তৈরি হয়ে যায় ছোটবেলার ক্লাব নেওয়েল ওল্ড বয়েজে। কিন্তু রোসারিও আর্জেন্টিনিয়ানরা রাতারাতি বার্সেলোনার সাপোর্টার হয়ে যান, এটা ভাবা কঠিন। অথচ কলকাতায় যেন পুরো হিসেবটাই আলাদা। ব্র্যান্ড কলকাতা ছাপিয়ে কখনও কখনও ব্র্যান্ড সৌরভ। একটা মানুষের সমর্থন ছাপিয়ে যায় একটা শহরের সমর্থনকে।
“গ্যালারির এই বাঁ দিকটা কিন্তু সেদিন পুণের পতাকায় ভরে ছিল। কলকাতার এত মানুষ সে দিন পুণেকে সমর্থন করবে ভাবিনি,” সৌরভের গলায় আবার ৫ মে। আবার ইডেন, আবার স্মৃতিচারণ। ‘‘পৃথিবীর সেরা মাঠ। আমি বিশ্বের সব ক’টা স্টেডিয়ামে খেলেছি, কিন্তু বিশ্বাস করুন, ইডেনের মতো মাঠ, দর্শক, আর কোথাও হয় না। এখানে খেলার মজাটাই আলাদা।” আর এই উত্তাপটা পেতেই বোধ হয় ইডেনে ফিরে আসা। ২৪ এপ্রিল। সচিন তেন্ডুলকরের জন্মদিন পালন করল ইডেন। আর সচিনের ওপেনিং পার্টনার চুপচাপ এসে বসলেন মুম্বই ইন্ডিয়ান্স ড্রেসিং রুমের ঠিক ওপরে। একেবারে সবার সঙ্গে। ইডেন গ্যালারির চেনা মেজাজটা কাচে ঘেরা কর্পোরেট বক্সে বসে বসে মিস করতে চান না। তাই বারবার চলে আসেন এই লোয়ার টিয়ারে। “ছোটবেলা থেকে তো এখানেই খেলা দেখছি। আমার কাচের দেওয়ালের ভেতরে বসে খেলা দেখতে ভালই লাগে না।” সিএবির যাঁরা আধিকারিক, কর্মী— তাঁরাও জানেন বিষয়টা। সৌরভ খেলা দেখতে যাবেন শুনলেই ক্লাবহাউসের লোয়ার টিয়ারের প্রথম সারির কয়েকটা সিট ওঁরা বুক করে রেখে দেন ওঁদের ক্রিকেটের সেরা বিজ্ঞাপনের জন্য।
|
|
এ বছর আইপিএল-য়ে কেকেআর ম্যাচ দেখতে ইডেনে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় |
গ্যাং গাঙ্গুলিকে নিয়ে মাঠে ঢোকার পুরো দায়িত্ব থাকে সৌরভের নিজের ওপর। অবধারিত কিছু শর্ত থাকবে। বাকিদের টিকিট থাকবে না। সব টিকিটের দায়িত্ব তাঁর। তাঁর পিছনে ধাওয়া করা গাড়িগুলোর পার্কিং স্টিকার থাকবে না। সৌরভ প্রতিটা চেকপোস্টে কাচ নামিয়ে পুলিশকে বলবেন, “পিছনের গাড়িগুলোও আমার সঙ্গে।” পুলিশ কৃতজ্ঞচিত্তে অনুমতি দেবে। গ্যালারিতে বসার পরই সঙ্গীসাথিদের খিদে পাবে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় সিএবি কর্মীরা এসে বিজলি গ্রিলের চিকেন কাটলেট আর পেপসি দিয়ে যাবে। যা ছড়িয়ে যাবে ‘গ্যাং গাঙ্গুলি’র সবার হাতে হাতে। এমনকী গ্যালারিতে দূরে বসা চেনা কাউকে দেখলেও সৌরভ পাঠিয়ে দেবেন জলের বোতল কিংবা পেপসির গ্লাস। এটুকু ছাড়াও সৌরভের সঙ্গে খেলা দেখার সেরা আকর্ষণ নির্ভুল প্রেডিকশন আর চুলচেরা বিশ্লেষণ। মুম্বইয়ের ১৬তম ওভারে হয়তো বললেন, “পরের ওভারে দেখো, সুনীল নারিনকে আনবে।” অবাক হয়ে দেখতে হয়, পরের ওভারে গৌতম গম্ভীর বল তুলে দিচ্ছেন নারিনকেই। শুধু তাই নয়, ব্যাটিং অর্ডারে কে কখন নামবে, বোলিং চেঞ্জে কার পর কো— সবটা নিয়ে থাকে প্রেডিকশন। আর অদ্ভুতভাবে আশি শতাংশ নির্ভুল। মুম্বই ইন্ডিয়ান্স ম্যাচে ব্যাট হাতে শেষ ওভারে হরভজন। নয় রান বাকি, হাতে চার বল। সৌরভ বললেন, “সর্দার কিন্তু ঘোরাবে।” পরের বলেই ভাজ্জির ছয় মাঠের বাইরে। বোলার রজত ভাটিয়া। এই পর্বটা সত্যিই অবাক হয়ে দেখতে কিংবা শুনতে হয়।
কিন্তু কী ভাবে সম্ভব? সৌরভ উত্তর দিতে গিয়ে একটু লাজুক, “ধুর, এতগুলো বছর ধরে এটাই তো করে যাচ্ছিলাম। যে কেউ পারবে।” আসল উত্তরটা অন্য। এতগুলো বছর ধরে ভারতীয় ক্রিকেটটা অন্য কেউ চেনেননি। ভাজ্জিদের মনের গভীরে এ ভাবে ডুব অন্য কেউ দেননি। ভারতের কোনায় কোনায় ক্রিকেটার খুঁজেও অন্য কেউ বেড়াননি। দিনের পর দিন ল্যাপটপের সামনে বসে থাকেননি কখনও নিজের দলের, আবার কখনও বিপক্ষের ব্যাটিং বিশ্লেষণে। যখন টিম ইন্ডিয়ার ক্যাপ্টেন ছিলেন তখনও দেখতাম, বিপক্ষ যে কোনও টিমের ব্যাটসম্যানদের রান, অ্যাভারেজ, গড়গড় করে বলে যাচ্ছেন।
এখনও তাই। সব ক’টা ফ্রাঞ্চইজির শক্তি, দুর্বলতা, সব ওঁর এখনও মুখস্থ।
“কায়রন পোলার্ডকে কেন উপরে খেলাচ্ছে না?” কয়েক দিন আগে এসএমএস করেছিলেন জন রাইটকে। যুক্তিটা পরিষ্কার। “ওর মতো ব্যাটসম্যান আনইউজড্ থাকছে বেশির ভাগ সময়।” পোলার্ড এ বার অনেক বেশি ম্যাচ জেতাচ্ছে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সকে।
ইডেন লোয়ার টিয়ারের ঠিক নীচেই জন রাইটদের ড্রেসিংরুম। মুম্বই ইন্ডিয়ান্স কোচ ড্রেসিংরুম আর ডাগ আউটের মাঝে পায়চারি করলেন অন্তত পঞ্চাশ বার। চোখাচোখি হতেই গুরু-শিষ্য দু’জনের মুখেই চওড়া হাসি। ফোনে কথা হবে, ইশারায় জানালেন জন। সৌরভ মাথা নাড়লেন। ম্যাচ শেষে আবার গ্যালারির দিকে তাকালেন কোচ। শিষ্য তখন বুড়ো আঙুল তুলেছেন। ভিকট্রি চিহ্ন। এক দশক আগে ভারতীয় ক্রিকেটে এ রকম কত নির্বাক বিজয় মুহূর্ত তৈরি হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। শুধু বদলে গিয়েছে সময়টা, অবস্থানগুলো।
ভাজ্জির ছয়টা বোধহয় আপশোসও বাড়াচ্ছিল। সেই একই বোলার। গত বছর ৫ মে, ইডেনের মাটিতে যাঁর বলে ডিপ মিড উইকেটে ক্যাচ দিয়ে ফিরেছিলেন, তিনিও ছিলেন রজত ভাটিয়াই। “আর চার ইঞ্চি আগে বা পরে বলটা পড়লেই খেলার রেজাল্টটা সে দিন অন্য হত। আমাকে ভাটিয়ার ওই ওভারটায় চান্স নিতেই হত। কারণ পরের ওভারটায় ওরা নারিনকে আনত। ওই শটটা মিস হিট না
হলে ম্যাচটা ঠিক জিতিয়ে ফিরতাম।” আর এখানেই বোধহয় অনেকটা অভিমান থেকে গিয়েছে পুণে ফ্রাঞ্চাইজির জন্যও। “ওদের আমি বারবার বলেছিলাম, আমাকে এতটা নীচে নামিও না। শুনলই না। যখন নামলাম, তখন আস্কিং রেট কত।” তবু ৫ মে’২০১৩-র এক বাঙালির বুক চিতিয়ে লড়াইটা কলকাতার মনে থাকবে। ২২ গজ থেকে ড্রেসিংরুমে ফিরছিলেন যখন, গোটা ইডেন উঠে দাঁড়িয়েছিল।
|
সে দিন কিং খান
আর ক্যাপ্টেন গাঙ্গুলি |
শ্রদ্ধায়, অভিনন্দনে। ২০০৮য়ের নভেম্বরে, নাগপুরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। কিন্তু কলকাতা জানত, আসল বিদায় নেওয়া ওটাই। ঘরের মাঠে, সবার সামনে। তার পরও কয়েকটা ম্যাচ খেলেছিলেন আইপিএল-য়ে। কিন্তু প্রাসঙ্গিক ছিল না কোনওটাই। ক্রিকেটকে তত দিনে ছুটিই দিয়েছেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়।
ক্রিকেটের পরের এই সময়টা সত্যিই মনখারাপের। নিজেই মাঝেমাঝে বলে ফেলেন, “ওই চ্যালেঞ্জটা আর নেই তো। তাই কিছু কিছু সময় একঘেয়ে লাগে। সেই কমেন্ট্রি, অফিস আর বাড়ি। মাঝে টিভির শো। আগে ঘুমোতে যাওয়ার আগে ভাবতাম, কালকের ম্যাচটা জিততে হবে। কিংবা সেঞ্চুরি করতে হবে। এখন সেটাই নেই।” ওঁকে খুব কাছ থেকে দেখে এই পর্বটা সত্যই খারাপ লাগার। ইডেনের ২২ গজে সেদিন সচিনদের হয়ে বল করছেন প্রজ্ঞান ওঝা। এই প্রজ্ঞানকেই ইডেনে পরপর চারটে ওভার বাউন্ডারি মেরেছিলেন সৌরভ। তিন বছর আগে। প্রজ্ঞান খেলছিলেন ডেকান চার্জার্সের হয়ে। সৌরভের ছিল দুর্দান্ত ৮৮ রান। ইডেন উত্তাল। উত্তাল ইডেনে এই সেদিনও প্রজ্ঞান খেলছেন। সৌরভ গ্যালারিতে বসা। সচিন, রাহুল, গিলক্রিস্ট সবাই খেলছেন। সৌরভ বসে। তবে আপশোস নেই আর। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে যখন বিদায় নিতে বাধ্য করা হয়েছিল, তখনও খেলছেন, সচিন, লক্ষ্মণ, রাহুল। পরে প্রায় চার বছর খেললেন ওঁরা।
সৌরভের আপশোস ছিল তখনও খানিকটা। জানতেন, আরও কিছু দিন চালিয়ে যেতে পারতেন। তখন বোধহয় উপলব্ধি করেন, সচিনের মতো কেন সরছে না শোনার চেয়ে তাঁর মতো সরে আসাই অনেক ভাল। নতুন দুনিয়ায় একটাই বড় তফাত, চটজলদি রেজাল্ট নেই। রাজারহাটে স্কুল করছেন। যে কোনও বিভাগের সরকারি অনুমতিতেই কিছুটা সময় লাগে। সৌরভের অত সময়, ধৈর্য নেই। রোজ রেজাল্ট চাই। অফিসের সহকর্মীরা বোঝান, “এই দুনিয়া এ রকমই। অপেক্ষা করতে হবে। আজ বললে কালই কি পারমিশন পাওয়া যায়! এটা তো ওয়ান ডে কিংবা টি২০ ক্রিকেট নয়।” সৌরভ বোঝেন। নতুন দুনিয়ায় স্টান্সের যে অনেক অদলবদল দরকার, বুঝতে চেষ্টা করেন।
নতুন দুনিয়ায় অনেকটা জুড়ে বরং সানা। মেয়ের সঙ্গে স্কুলের হোমওয়ার্ক থেকে মেয়ের বন্ধুদের সঙ্গে খেলা— ক্যাপ্টেন গাঙ্গুলির দুনিয়াটা বদলে গিয়েছে দ্রুত। ইডেনের দুপুরে চোয়াল চেপে কামব্যাকের লড়াই করা মানুষটার সঙ্গে এই সৌরভের তফাত যে অনেকটাই। প্রবল ভাবনা বরং বাংলা নিয়ে। বাংলার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে। “ইন্ডাস্ট্রি দরকার।
খুব দরকার। এখনই দরকার। রাজনীতি বুঝি না। কিন্তু আমি সুযোগ পেলে টাটা, অম্বানী, ইনফোসিসদের কাছে গিয়ে হাতজোড় করেও বলতে পারি, পশ্চিমবঙ্গে চলুন। বাংলায় কিছু করুন।”
সল্টলেকে নিজের ক্রিকেট অ্যাকাডেমিটা ঢেলে সাজাতে চাইছেন। নিজেও সময় দিতে চাইছেন অকাদেমিতে। স্কুল গড়ার পিছনেও কোথাও বোধহয় ওই স্বপ্নটা লুকিয়ে আছে, “বাংলা থেকে লিডার চাই। পড়াশোনা হোক, খেলাধুলো হোক, সিনেমা হোক যা কিছুই হোক। দুর্গাপুরের বাইরে বাঙালি ছেলেদের কেউ চিনবে না, সেটা চলতে পারে না।
রোজ আন্দোলন, গণ্ডগোলের বাইরে বাঙালির একটা পরিচিতি থাকতেই হবে।”
ইডেন থেকে বের হতে হল নিরাপত্তার ঘেরাটোপে। ক্লাবহাউসের সামনের রাস্তায় যখন দাঁড়িয়েছেন, উপচে পড়ছে ভিড়। এখনও তাঁকে দেখার জন্য, ছোঁয়ার জন্য মানুষের প্রবল চেষ্টা। সে ভাবেই উঠলেন গাড়িতে। প্রবল হুড়োহুড়িতে। সাধারণ বাঙালির, হারতে থাকা বাঙালির, চিট ফান্ডে-রাজনৈতিক কোন্দলে আত্মঘাতী বাঙালির একমাত্র জয়ী নায়ক যে এখনও তিনিই।
|
ছবি: সন্তোষ ঘোষ |
|
|
|
|
|