অবশেষে ঘুম ভাঙল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের।
দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ আসছিল যে, বিকেলের পর থেকেই ইনটেনসিভ থেরাপি ইউনিট (আইটিইউ) এবং রেসপিরেটরি কেয়ার ইউনিটে (আরসিইউ) ভর্তি থাকা সঙ্কটজনক রোগীদের রক্তের নমুনা কয়েক গুণ বেশি খরচ করে বাইরের ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করতে পাঠাচ্ছেন চিকিৎসকদের একাংশ। বাইরের কয়েকটি বেসরকারি ল্যাবরেটরির সঙ্গে যোগসাজশেই এমনটা ঘটছে। এর মধ্যে কিছু পরীক্ষা হাসপাতালে হয় না এবং আরও বেশ কিছু পরীক্ষা জরুরি ভিত্তিতে করা প্রয়োজন এ কথা ঠিক। কিন্তু তার বাইরেও রুটিন বহু পরীক্ষা হাসপাতালের বাইরে পাঠানো হচ্ছে বলে বহু বার লিখিত অভিযোগও জমা পড়েছে হাসপাতালে। কিন্তু কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অবশেষে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে নির্দেশিকা জারি করলেন। তাতে বলা হয়েছে, বাইরে কোনও পরীক্ষা করতে পাঠানো হলে প্রেসক্রিপশনে স্পষ্ট অক্ষরে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের নাম, তাঁর সই এবং হাসপাতালের রাবার স্ট্যাম্প মারতে হবে। এই নিয়ম মানা না হলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ।
এসএসকেএম তথা ‘ইনস্টিটিউট অফ পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন মেডিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ’-এর অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র বলেন, “আগে ল্যাবরেটরি ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকত না। সেই সময়ে নমুনাগুলি বাইরে পাঠানোর পিছনে ল্যাবরেটরি খোলা না থাকার যুক্তিই খাড়া করা হত। বহু চেষ্টাচরিত্র করে রাতে ল্যাবরেটরিতে কর্মী রাখার ব্যবস্থা হল। কিন্তু সেখানে নমুনা আসে না। কর্মীরা পাল্টা অভিযোগ করছেন, রাতে ডিউটি করে কী লাভ, কোনও কাজই থাকে না।” প্রদীপবাবু জানান, তাঁরা খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, যে সব পরীক্ষা বাইরে করতে পাঠানো হচ্ছে, তার বেশির ভাগই হাসপাতালে হয়।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন, কেন বাইরে রক্ত পরীক্ষা করতে পাঠানো হচ্ছে, তা জানতে চাওয়া হলে বহু সময়েই চিকিৎসকেরা স্পষ্ট কোনও উত্তর দিতে পারেন না। এমনকী, বহু চিকিৎসক বাইরে রক্ত পরীক্ষা করতে পাঠানোর বিষয়টি বেমালুম অস্বীকারও করে যান। ফলে প্রমাণের অভাবে নির্দিষ্ট ভাবে কাউকেই কখনও দায়বদ্ধ করা যায় না। এই কারণেই এ বার চিকিৎসকদের নাম, সই এবং রাবার স্ট্যাম্প বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে।
আরসিইউ-এ ভর্তি এক রোগীর আত্মীয় বলেন, “রাত ন’টায় ডাক্তারবাবু রক্তের নমুনা ধরিয়ে বললেন, ‘এখনই থাইরয়েডের পরীক্ষা করতে দিন। হাসপাতালে হবে না। বাইরের ক্লিনিকে যেতে হবে।’ কোথায় যেতে হবে, সেটাও উল্লেখ করে দিলেন তিনি। রোগীকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছি, তাই ডাক্তারবাবুর মুখের উপরে বলার সাহস পাইনি যে, বাইরের ল্যাবরেটরির পরীক্ষার রিপোর্টও তো পরের দিনই পাওয়া যাবে। তা হলে পরের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করা হবে না কেন? হাসপাতাল সূত্রে খবর, প্রতি দিন অজস্র রোগীর ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটে চলেছে। রোগী অনুযায়ী শুধু পরীক্ষার নামগুলো বদলে যায়।
চিকিৎসকদের একটা অংশ অবশ্য পাল্টা দায়ী করেছেন সরকারি ব্যবস্থাকেই। তাঁদের অভিযোগ, প্রয়োজনীয় বহু পরীক্ষা হাসপাতালে করানোই হয়ই না। তা ছাড়া, হাসপাতালের ল্যাবরেটরির হাল এমনই খারাপ যে, সাধারণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রেও সেখানকার রিপোর্টে ভরসা রাখা যায় না। কর্তৃপক্ষ অবশ্য জানিয়েছেন, এমন অভিযোগ চিকিৎসকেরা কখনও কর্তৃপক্ষের কাছে বা স্বাস্থ্য দফতরে করেন না। করেন শুধু রোগীর বাড়ির লোকেদের কাছেই। আর রোগীর অসহায় পরিজনেরা ডাক্তারের সেই কথার ভিত্তিতেই নমুনা নিয়ে বাইরে ছোটেন।
এসএসকেএমের এক প্রশাসনিক কর্তা বলেন, “আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি, যে সব ল্যাবরেটরিতে নমুনা রেফার করা হচ্ছে, সেখানকার খরচ সরকারি তো বটেই, এমনকী অন্যান্য বেশ কিছু বেসরকারি ল্যাবরেটরির তুলনায়ও অনেকটা বেশি। তা ছাড়া শুধু টাকা নয়, রক্তের নমুনা নিয়ে ছোটাছুটি করতে গিয়ে রোগীর পরিবারের লোকের শারীরিক ভোগান্তিও হয়। সেটা বন্ধ করাও অত্যন্ত জরুরি।” এর আগে ‘জেনেরিক’ নামে প্রেসক্রিপশন লেখা নিয়ে সরব হয়েছিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা ব্র্যান্ড নামে ওষুধ লিখলে প্রেসক্রিপশন দেখে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন তিনি। তার পরে পরিস্থিতি কিছুটা বদলায়। এ বার নির্দেশিকা জারি করে রক্ত নিয়ে এই দুর্নীতি-চক্রে কোনও পরিবর্তন আনা যায় কি না, সে দিকেই তাকিয়ে রয়েছেন এসএসকেএম কর্তৃপক্ষ। |