বেআইনি লগ্নি সংস্থার দৌরাত্ম্য দমনে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ এবং কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমের নির্দেশে এ বার একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন শীর্ষ নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠিত হতে চলেছে। এর ফলে গোটা দেশেই এই ধরনের সংস্থাগুলির উপর নজরদারি ব্যবস্থা এক ছাতার তলায় চলে আসবে। আজ অর্থ মন্ত্রকের কর্তাদের সঙ্গে সেবি, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির কর্তাদের বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। অফিসে বসে জবাবদিহি চাওয়ার বদলে মাঠে নেমে লগ্নি সংস্থাগুলির ব্যবসা খতিয়ে দেখার কাজ করবে এই সংস্থা। নজরদারির জন্য ‘মিস্ট্রি শপিং’-এর কৌশল নেওয়া হবে। অর্থাৎ সরকারি কর্মীরা নিজেরাই আমানতকারী সেজে লগ্নি সংস্থাগুলির কাছে যাবেন।
অর্থ মন্ত্রক মনে করছে, সারদার মতো সংস্থাগুলির রমরমা থেকেই প্রমাণ হয়ে গিয়েছে যে ব্যাঙ্ক, বিমা বা ডাকঘরের উপরে বহু মানুষের ভরসা নেই। আর সেই কারণেই লগ্নি সংস্থায় টাকা রেখে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন তাঁরা। তাই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ও বিমা সংস্থাগুলিকে এ বার গ্রাম ও ছোট শহরগুলিতে আরও তৎপর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন চিদম্বরম। লগ্নি সংস্থাগুলির দাপটে স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পেও ভাটা পড়েছে। সেই কারণে নজরদারির পাশাপাশি গোটা দেশে প্রচার-যুদ্ধে নামতে চাইছে অর্থ মন্ত্রক। মন্ত্রকের কর্তারা মনে করছেন, সারদা কাণ্ডের পর মানুষকে স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পে টেনে আনার এটাই উপযুক্ত সময়। এ ব্যাপারে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের সঙ্গে কথা হয়েছে তাঁদের।
লগ্নি সংস্থার বেআইনি কাজকর্ম ঠেকানোর দায় কার, তা নিয়ে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে চাপানউতোর অব্যাহত। এই টানাপোড়েন বন্ধ করে আসল কাজে মন দেওয়া দরকার বলে মনে করছেন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির কর্তারা। স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান প্রতীপ চৌধুরী বলেন, “পারস্পরিক দোষারোপটা আমাদের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত নয়। একটা ঘটনা ঘটার পরে গেল গেল রব ওঠে। কিন্তু আমাদের উচিত মাঠে নেমে যাতে নজরদারি হয়, তার ব্যবস্থা করা। মানুষকে সচেতন করার জন্য প্রচার গড়ে তুলতে হবে।” এসবিআই চেয়ারম্যানের যুক্তি, ‘জাগো গ্রাহক জাগো’ বা হলমার্ক দেখে কেনার মতো প্রচারে যথেষ্ট ইতিবাচক ফল মিলেছিল। ফলে ব্যাঙ্ক বা বিমায় সঞ্চয়ের উপকারিতাও মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করাই যায়।
গোটাটাই চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ার দশা কি না, তা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন থাকছে। তবে লগ্নি সংস্থাগুলির উপর নজরদারির জন্য কেন্দ্র যে এ বার কোমর বেঁধে মাঠে নামতে চাইছে, তাতে সন্দেহ নেই। অর্থ মন্ত্রকের আর্থিক পরিষেবা দফতরের সচিব রাজীব টাকরু জানান, “একটি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন সংস্থা তৈরি হবে। যার মাথায় থাকবে সেবি, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকের কর্তাদের নিয়ে তৈরি একটি গোষ্ঠী। ওই গোষ্ঠীই লগ্নি সংস্থার উপর নজরদারি চালাবে। প্রতি মাসে তার বৈঠক বসবে।” মন্ত্রক সূত্রে খবর, এত দিন লগ্নি সংস্থাগুলির কোনটি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের, কোনওটি আবার সেবি-র আওতাধীন ছিল। একাধিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা থাকায় আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগও ছিল অনেক বেশি। সেই সম্ভাবনা এড়াতে এখন সব রকম লগ্নি সংস্থাকে সেবি-র অধীনে আনা হবে। সেবি-র চেয়ারম্যান ইউ কে সিনহা বলেন, “চিট ফান্ড, পন্জি স্কিম, যে নামই হোক না কেন, যে কোনও ধরনের অর্থ সংগ্রহের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা একটিমাত্র সংস্থার হাতে থাকা প্রয়োজন। সরকারও এ বিষয়ে একমত। বেআইনি উপায়ে টাকা তোলা বন্ধ করতে সেবি-কে আরও বেশি ক্ষমতা দেওয়া হবে।”
আগের ব্যবস্থার সঙ্গে বর্তমান ব্যবস্থার ফারাকটা কোথায়? অর্থ মন্ত্রক সূত্রের খবর, সারদা বা সহারা সংস্থার ক্ষেত্রেও সেবি ব্যবস্থা নিয়েছিল। সারদা গোষ্ঠীর বিভিন্ন সংস্থাকে নোটিস পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু পেটি ভর্তি অপ্রয়োজনীয় নথি পাঠিয়ে সেবি-র তদন্ত দেরি করিয়ে দেওয়ার কৌশল নিয়েছিলেন সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেন। মাঠে নেমে তাদের কাজকর্ম খতিয়ে দেখার ব্যবস্থা না থাকায় সমস্যা হচ্ছিল। এখন থেকে সারদার মতো সংস্থাগুলি কী ভাবে আমানতকারীদের থেকে টাকা তুলছে, বিনিময়ে কী প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, গ্রামে গ্রামে ঘুরে সে বিষয়ে নজরদারি চালানো হবে। নজরদারি সংস্থার কর্মীরা আমানতকারী সেজে লগ্নিকারী সংস্থার দরজায় হাজির হবেন। তাতে ভাঁওতার ছক বোঝা যাবে বলে আশা অর্থমন্ত্রকের।
একই সঙ্গে সাধারণ মানুষকে ব্যাঙ্ক ও বিমা ক্ষেত্রে সঞ্চয়ের পথে নিয়ে আসারও চেষ্টা করবে অর্থ মন্ত্রক। গোটা দেশেই গ্রাম ও ছোট শহরগুলির অধিকাংশ বাসিন্দার এখনও ব্যাঙ্কের পরিষেবা ও সেখানে টাকা জমা রাখার সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই। তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ কৃষিভিত্তিক রাজ্য হওয়ার ফলে আরও পিছনের সারিতে। কলকাতা বাদে বাকি সব জেলার অবস্থা খুবই খারাপ। গোটা দেশের ছবিটাও মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। দেশের মোট জনসংখ্যার পাঁচ ভাগের মাত্র দু’ভাগের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। মনমোহন-সরকার যেখানে ব্যাঙ্কের মাধ্যমে সরাসরি নগদ ভর্তুকি দেওয়ার চেষ্টা করছে, সেখানে এই পরিসংখ্যান উদ্বেগের বিষয়।
এর কারণ কী? রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কর্তারা মনে করছেন, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য ন্যূনতম যে পরিমাণ টাকা প্রয়োজন, গরিব মানুষের তত আয় নয়। অধিকাংশ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে দৈনিক জমা প্রকল্পও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ডেপুটি গভর্নর কে সি চক্রবর্তীর মন্তব্য, “মানুষ যে লগ্নি সংস্থার উপর ভরসা রাখছেন, তা থেকেই প্রমাণ হয়, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা এখনও তাঁদের কাছে পৌঁছতে পারেনি। তাঁদের আস্থা অর্জন করা যায়নি। ছবিটা বদলাতে একটা স্বচ্ছ ও তৎপর গ্রাহক পরিষেবা ব্যবস্থা প্রয়োজন। যেখানে ব্যাঙ্ক পরিষেবা নেই, সেখানে তা পৌঁছে দিতে হবে।” ব্যাঙ্কের গ্রামীণ শাখার কর্মীদেরও এ বিষয়ে তৎপর হওয়ার নির্দেশ দিচ্ছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক।
কিন্তু হঠাৎ করে লগ্নি সংস্থাগুলি বন্ধ করে দিলেও সমস্যা হতে পারে বলে করছেন অর্থ মন্ত্রকের কর্তাদের একাংশ। কারণ বহু মানুষ যেমন এই সব সংস্থায় লগ্নি করেছেন, তেমন লক্ষ লক্ষ এজেন্টের রুটিরুজিও চলছে। তাঁদের বিকল্প ব্যবস্থা কী হবে, তার কোনও সদুত্তর এখনও নেই। কেন্দ্রের অনেক আর্থিক উপদেষ্টা আবার প্রশ্ন তুলছেন, এত দিন কি সরকার চোখে ঠুলি পরে বসেছিল? তাঁদের যুক্তি, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি যে বেসরকারি ব্যাঙ্কের প্রতিযোগিতায় এঁটে উঠতে গ্রামে শাখা খোলায় উৎসাহ দেখাচ্ছে না, তা কারও অজানা নয়। ১৯৯১ সালে গ্রামীণ শাখার হার ছিল ৫৮ শতাংশ। ২০১১ সালে তা নেমে এসেছে ৩৭ শতাংশে। ১৯৯১ সালে ১৩ হাজার মানুষ পিছু একটি শাখা ছিল। এখন তা ১৮ হাজারে এসে পৌঁছেছে। অর্থ মন্ত্রক যুক্তি দিচ্ছে, নতুন ব্যাঙ্ককে লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ব্যাঙ্কের সংখ্যা বাড়লে প্রতিযোগিতা বাড়বে। যে সব গ্রাম বা ছোট শহরে ব্যাঙ্কের শাখা নেই, সেখানেও ব্যাঙ্কগুলি ব্যবসা বাড়াতে চাইবে। নতুন লাইসেন্স দেওয়ার শর্তেও রাখা হয়েছে, যে সব এলাকায় কোনও ব্যাঙ্কের শাখা নেই, সেখানে শাখা খুলতে হবে। অন্য লগ্নি সংস্থায় নজরদারির জন্য উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন গোষ্ঠী তো থাকছেই।
নর্থ ব্লকের পোড় খাওয়া আমলাদের প্রশ্ন, এই নজরদারির ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ চলে আসবে না তো? |