|
|
|
|
বিনোদন |
বাংলা ছবির প্রচারে সেন্সরের
কোপ, ক্ষুব্ধ টলিউড
ইন্দ্রনীল রায় • কলকাতা |
|
|
একেই বলে, গোদের উপরে বিষফোড়া।
টলিউড আর লগ্নি সংস্থার আঁতাঁত নিয়ে এমনিতেই যথেষ্ট শোরগোল। তার উপর সেন্সর বোর্ডের এক নতুন নির্দেশে বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির মাথায় হাত।
কেন? কারণ, সেন্সর বোর্ডের সদ্য পাঠানো একটি নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, এ বার থেকে সেন্সর ছাড়পত্র পাওয়ার আগে বাংলা ছবির প্রযোজক-পরিবেশকরা বিজ্ঞাপন-ট্রেলার-পোস্টার কিছুই প্রকাশ করতে পারবেন না।
সাধারণ ভাবে কোনও ছবি সেন্সরের ছাড়পত্র পায় রিলিজের এক সপ্তাহ আগে। ছবি রিলিজের আগের দিনই ছাড়পত্র এসে পৌঁছেছে, এমনও হয়। ছবির ট্রেলার, পোস্টার-সহ প্রচারের যাবতীয় কাজ স্বাভাবিক আগেই তার অনেক দিন আগে থেকেই পুরোদমে শুরু হয়ে যায়। নয়া নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে হলে সেন্সরের ছাড়পত্র পাওয়ার প্রায় দু’মাস পরে ছবি রিলিজ করবে। কারণ ছাড়পত্র পেয়ে তবে প্রচারের কাজ শুরু করে ছবি প্রেক্ষাগৃহে আনতে ওই সময়টা লেগে যাবে। তাতে প্রযোজকদের উপরে বাড়তি আর্থিক চাপ তৈরি হবে। শ্রীকান্ত মোহতা-সহ টলিউডের প্রথম সারির সব প্রযোজকই তাই একযোগে প্রশ্ন করছেন, “যদি কোনও ছবির বাজেট হয় এক কোটি, সেই ছবি তৈরি হয়ে যাওয়ার পরে ৫০-৬০ দিন বসে থাকতে হলে যে বাড়তি সুদ গুনতে হবে, তার টাকা কে দেবে?” |
|
সেন্সর বোর্ডের নির্দেশিকা। |
প্রশ্ন হল, আঞ্চলিক সেন্সর বোর্ড এমন একটা নির্দেশ দিল কেন আদৌ? ইন্ডাস্ট্রির অনেকে মনে করছেন, মৈনাক ভৌমিকের নতুন ছবি নিয়ে বিতর্কের জেরেই সেন্সর এই পদক্ষেপ করেছে। মৈনাকের ‘আমি আর আমার গার্লফ্রেন্ডস’ সেন্সর ছাড়পত্র পাওয়ার আগেই রিলিজের দিন ঘোষণা করেছিল। টালিগঞ্জের ভিতরের অনেকে দাবি করছেন, তাদের শিক্ষা দিতেই সেন্সর বোর্ড এমন নির্দেশ দিয়েছে। সেন্সর বোর্ড সূত্রেরও খবর, ‘‘ছাড়পত্র পাওয়ার আগেই ‘মুক্তির দিন ঘোষণা করে দেওয়াকে ভাল ভাবে নেননি সেন্সর আধিকারিকরা।”
‘আমি আর আমার গার্লফ্রেন্ডস’ মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল গত মাসের ২৬ তারিখ। ছবির পোস্টারে সে কথা আগাম ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছিল। অথচ ছবিটি তখনও অবধি সেন্সরের ছাড়পত্রই পায়নি। পরে সেন্সরের নির্দেশ অনুযায়ী দু’টি পরিবর্তন-সহ ছবিটি মুক্তির জন্য প্রস্তুত। শোনা যাচ্ছে, ১০ মে হল-এ আসতে পারে সেটি।
তবে নতুন নির্দেশিকা যে এই ঘটনার জেরেই, তা মানতে চাননি রিজিওনাল সেন্সর বোর্ডের প্রধান ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর দাবি, “নির্দেশটা ‘আমি আর আমার গার্লফ্রেন্ডস’য়ের জন্য আনা হয়নি। আমরা নতুন কিছু করিনি। নিয়মটা আগে থেকেই ছিল। ১৯৫২-র সিনেমাটোগ্রাফ আইনের ৩৮তম ধারাতেই পরিষ্কার বলা আছে যে, পুরো ছবি সেন্সর না হলে সেই ছবির পাবলিসিটি করা যাবে না।”
কিন্তু হঠাত্ এত বছর পরে নতুন করে এই নির্দেশ কেন জারি করা হল? বলিউডে তো ছবির মহরতের দিনই ছবির রিলিজের দিন ঘোষণা করে দেওয়াই রেওয়াজ! তার বেলা? “মুম্বইয়ে কী হয়, সেটা মুম্বই বুঝবে। নিশ্চয়ই কোনও অনিয়ম আমাদের নজরে এসেছে, যার জন্য আমরা বাংলায় এই রুলিংটা এনেছি,” স্পষ্ট বললেন ভাস্কর। আইন মোতাবেক সেন্সর ছাড়পত্র পাওয়ার আগে ছবির মুক্তির দিন জানানো যায় না, সে কথা ঠিকই। ‘আমি আর আমার গার্লফ্রেন্ডস’-এর তরফে যে ভুল হয়েছিল, টালিগঞ্জও সেটা মানছে। এক বর্ষীয়ান অভিনেতা সরাসরি বললেন, “সেন্সর হওয়ার আগে পোস্টারে ছবির মুক্তির দিন লেখা যায় না। যারা এটা করেছে, তাদের উচিত ছিল, বই কিনে নিয়মগুলো পড়া।” কিন্তু টালিগঞ্জের তাবত্ পরিচালক-প্রযোজক-অভিনেতার এখন একটাই প্রশ্ন, “সেন্সর বোর্ড চাইলে মুক্তির দিন ঘোষণার উপরেই তো নিষেধাজ্ঞা আনতে পারত! গোটা প্রচারপর্বটা আটকে দেওয়ার কী যুক্তি?” পরিচালক অনীক দত্ত বিস্মিত, “সেন্সরের আগেই ‘আমি আর আমার গার্লফ্রেন্ডস পোস্টারে’ ডেট দিয়ে দিয়েছিল, যেটা হয়তো নিয়ম-বহির্ভূত। কিন্তু কোনও পোস্টার-ট্রেলরও আগে ব্যবহার করা যাবে না, এটা হলে ছবির বিজ্ঞাপন হবে কী করে?” |
|
বিতর্কিত ‘আমি আর আমার গার্লফ্রেন্ডস’ ছবির একটি দৃশ্য। |
“সেন্সর বোর্ড ইন্ডাস্ট্রিকেই শেষ করে দিতে চাইছে। আজকের দিনে, পাবলিসিটি কোনও ছবিকে দাঁড় করায় বা শুইয়ে দেয়। কিন্তু এই নির্দেশের পরে তো রিলিজের দু’মাস আগে ছবি শেষ করে ফেলে রাখতে হবে। এটা হাস্যকর,” বললেন প্রযোজক অশোক ধানুকা। ছবির পাবলিসিটির ক্ষেত্রে এখন ইউটিউব-ফেসবুক-ট্যুইটারের মতো নতুন মিডিয়াও জায়গা করে নিয়েছে। সেগুলোও কি সেন্সর বোর্ডের কোপে পড়বে? “সেন্সরের নির্দেশের মধ্যে নতুন মিডিয়া পড়বে কি না, তা নিয়ে কারও কোনও ধারণা নেই। ঈশ্বরই জানেন, সেন্সর বোর্ড কেন ইন্ডাস্ট্রিকে সাবোটাজ করতে চাইছে,” বলছেন প্রযোজক রানা সরকার।
ইন্ডাস্ট্রির প্রশ্ন, এত দিন সবার আগে সেন্সরের কাছে যেত ছবির পোস্টার, ট্রেলর, তার পর আস্ত ছবিটা। যে সব পোস্টার-ট্রেলর ছবির প্রচারে ব্যবহার হত, সেগুলো সেন্সরের ছাড়পত্র নিয়েই ব্যবহার হত। এখন যদি পুরো ছবি সেন্সর না-হওয়া ইস্তক পোস্টার-ট্রেলর কিছুই ব্যবহার না হয়, তা হলে সেগুলো আগেভাগে পাঠানোর প্রক্রিয়াটাই অবান্তর হয়ে যায়!
তা ছাড়া, সেন্সর-প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে এমনিই টালিগঞ্জের ভূরি ভূরি নালিশ আছে। ছবি দেখার লোকই পাওয়া যায় না। লোক পাওয়া যায় তো, ডেট পাওয়া যায় না! ছবি সেন্সর করাতে মাস পেরিয়ে যায় বলে অভিযোগ। ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত নতুন নির্দেশিকা সমর্থন করছেন না। তা-ও বললেন, “যদি নতুন নিয়ম একান্তই বলবত্ হয়, তা হলে সেন্সরকে আরও দায়িত্ব নিতে হবে। ছবি সেন্সর করতে গেলে যে পরিমাণ ‘ডিলে’ হয়, সেগুলো বন্ধ করতে হবে!”
সামগ্রিক ভাবে বাংলা ছবির পক্ষেই সেন্সরের নতুন নির্দেশ যথেষ্ট বিপজ্জনক বলে মনে করছে টালিগঞ্জ। মহেন্দ্র সোনির কথায়, “পুরো ভারতে সব ইন্ডাস্ট্রি রিলিজ ডেট আগে জানিয়ে দেয়। কোথাও পুরো ছবির সেন্সর না হলে পাবলিসিটি করা যাবে না, এমন নিয়ম নেই। আমরা পুরো ইন্ডাস্ট্রি একজোট হয়ে এর প্রতিবাদ করব।” টালিগঞ্জের সকলেরই বক্তব্য, “গোটা প্রচারব্যবস্থাকে আটকে দেওয়াটা সমর্থনযোগ্য নয়। সারা ভারতে এক রকম নিয়ম আর বাংলা ছবির জন্য আর এক, এটা মানা যায় না।”
অর্থাত্ পরিস্থিতি যে দিকে যাচ্ছে, সেন্সর বোর্ড বনাম টালিগঞ্জের তরজা আগামি কয়েক দিনে আরও
বাড়বে। ভাস্করবাবু কিন্তু অটল। “যা নিয়ম, তা-ই করেছি। তাতে বাংলা ছবির ক্ষতি হবে, না ভাল, সেই দায়িত্ব আমার নয়!” |
|
|
|
|
|