পুলিশি ‘সন্ত্রাসের’ প্রতিবাদে থানায় বিক্ষোভ করতে যাওয়া মহিলাদের লাঠিপেটা করার অভিযোগ উঠল পুলিশের বিরুদ্ধেই।
ধর্ষণের ঘটনার তদন্তে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগে মঙ্গলবার রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় বর্ধমানের রানিগঞ্জ। জাতীয় সড়ক অবরোধ, পুলিশ-জনতা খণ্ডযুদ্ধ, পুলিশের গাড়ি-সহ বহু বাস, গাড়িতে ভাঙচুর-আগুন লাগানো হয়। অভিযোগ, এর পরেই গণ্ডগোলে জড়িতদের ধরার নামে মঙ্গল ও বুধবার রাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাণ্ডব চালায় পুলিশ। প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার সকালে রানিগঞ্জ থানায় বিক্ষোভ দেখাতে যান কয়েকশো মহিলা। তখনই পুলিশ তাঁদের লাঠি চালিয়ে ছত্রভঙ্গ করে বলে অভিযোগ। ঘটনার পরে এলাকাবাসী শান্তি বজায় রাখার দাবিতে একটি মিছিল করেন। থানায় স্মারকলিপিও দেন।
|
বিক্ষোভ দেখাতে আসা মহিলাদের হটিয়ে দিচ্ছে পুলিশ। —নিজস্ব চিত্র। |
আসানসোল-দুর্গাপুরের পুলিশ কমিশনার অজয় নন্দ বাড়িতে ঢুকে তাণ্ডব বা এ দিন মহিলাদের উপরে লাঠি চালানোর অভিযোগ মানেননি। তিনি জানান, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগে ৫৪ জনকে ধরা হয়েছে।
সোমবার দুপুরে রানিগঞ্জে ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে স্থানীয় দুই যুবকের বিরুদ্ধে। ওই দুই যুবক তৃণমূল সমর্থক হওয়ায় পুলিশ প্রথমে এফআইআর নিতে চায়নি, এই অভিযোগে এলাকাবাসী থানায় বিক্ষোভ করেন। পরে ৬০ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ করা হয়। রাতে অভিযুক্তেরা ধরা পড়লেও মঙ্গলবার ফের অবরোধ হয়। পুলিশ লাঠি চালালে ক্ষিপ্ত জনতা গাড়ি, বাস, মোটরবাইক ভাঙচুর করে। জখম হন ১০ পুলিশকর্মী।
গোলমালে জড়িতদের ধরতে মঙ্গল ও বুধবার রাতে অভিযানে নামে পুলিশ। ওই ছাত্রীর যেখানে বাড়ি, সেই এলাকা ও লাগোয়া বাউড়িপাড়ায় তল্লাশি চালানো হয়। স্থানীয় বাসিন্দা কমলেশ যাদবের অভিযোগ, “পুলিশ মাঝরাতে দরজা ভেঙে বাড়িতে ঢোকে। গালিগালাজ করে, ইট-পাটকেল ছোড়ে। বাড়ির তিন বছরের শিশুর মাথায় ইট লাগে।” বাউড়িপাড়ায় সেই রাতে বিয়ে ছিল উৎপল বাউড়ির। তাঁর ভাই গৌরাঙ্গের অভিযোগ, “১১টা নাগাদ পুলিশ এসে বিয়েবাড়ির জন্য রাস্তায় লাগানো দু’টি টিউবলাইট ভেঙে দেয়। মেন স্যুইচ বন্ধ করে দেয়। বিয়েবাড়িতে ঢুকে উনুন-সহ নানা জিনিসপত্র ভেঙে চলে যায়।” কলেজপাড়ার বৃদ্ধা পুষ্প গড়াই বলেন, “আমি বাড়িতে একা ছিলাম। পুলিশ এসে কিছু না পেয়ে উনুন ভেঙে দেয়।” এলাকার অনেককে মারতে মারতে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় বলে দাবি বাসিন্দাদের। |
তপ্ত রানিগঞ্জ। এলাকায় শান্তি ফেরানোর দাবিতে মিছিল
করলেন এলাকার বাসন্দারা। ওমপ্রকাশ সিংহের তোলা ছবি। |
বুধবার রাতেও একই রকম ঘটনা ঘটে ওই এলাকায়। ভগৎপাড়ার মায়াদেবী সাহুর কথায়, “পুলিশ আমার তিন ছেলে ও জামাইকে মারধর করে। বাধা দিতে গিয়ে আমি ও আমার অন্তঃসত্ত্বা মেয়ে মার খাই।” তিনি জানান, তাঁর তিন ছেলেকে ধরে নিয়ে গিয়েছে পুলিশ। মায়াদেবীর দেওর দীপু সাহু বলেন, “পাশের বাড়িতে গোলমাল শুনে বাইরে বেরোতেই আমাকে মারধর করা হয়।” কলেজপাড়ার সুধাময় সাউয়ের অভিযোগ, “পুলিশ বাড়িতে ঢুকে তছনছ শুরু করে। হাতের কাছে পেয়ে দু’টি খরগোশকে তাদেরও পিটিয়ে মারে।”
এই ঘটনার প্রতিবাদে এলাকার মহিলারা এ দিন রানিগঞ্জ থানায় বিক্ষোভ দেখাতে যান। ছায়া দেবী, বিমলা বাউড়িদের অভিযোগ, “নিরপরাধ লোকজনকে হেনস্থা না করে প্রকৃত অপরাধীদের ধরার কথা বলতে গিয়েছিলাম পুলিশকে। কিন্তু কোনও কথা না শুনে মেরে তাড়িয়ে দেওয়া হল!” এ দিনের ঘটনা নিয়ে রানিগঞ্জ ব্লক কংগ্রেস মহকুমা প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দেয়। দলের ব্লক সভাপতি অনল মুখোপাধ্যায় তল্লাশির নামে পুলিশি ‘সন্ত্রাসের’ বিচারবিভাগীয় তদন্ত দাবি করেন। একই সঙ্গে যারা অশান্তি তৈরি করছে তাদের বিরুদ্ধেও কড়া ব্যবস্থার দাবি জানান। |
মহিলাদের উপরে পুলিশের লাঠি চালানোর প্রতিবাদে থানার সামনে বিক্ষোভ ও
স্মারকলিপিও দেওয়া হল। বৃহস্পতিবার ওমপ্রকাশ সিংহের তোলা ছবি। |
অনলবাবুর দাবি, “আমাদের ধারণা, এই অশান্তির পিছনে রয়েছে সিপিএমের একটি অংশ।” একই অভিযোগ তুলেছেন রানিগঞ্জের তৃণমূল বিধায়ক সোহরাব আলিও। তাঁর বক্তব্য, “একটি লজ্জাজনক ঘটনা ঘটেছে। আমি মেয়েটির বাড়ি গিয়েছিলাম। পুলিশের ভূমিকায় তাঁরা খুশি। কিন্তু সিপিএম এ নিয়ে এলাকা অশান্ত করতে চাইছে।”সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য তুফান মণ্ডল যদিও তা মানেননি। তাঁর পাল্টা দাবি, “তৃণমূলের চাপে পুলিশ নিষ্ক্রিয়। কোনও কিছুরই ঠিক মতো তদন্ত হচ্ছে না। পুলিশ ধর্ষণে অভিযুক্তদের হেফাজতে নিল না, অথচ গণ্ডগোলে ধৃতদের ১৬ জনকে হেফাজতে নিয়েছে। এ সব নিয়েই মানুষ ক্ষুব্ধ। রানিগঞ্জ থানায় পুরুষ পুলিশকর্মীরা বিক্ষোভরত মহিলাদের মারধর করেছে। আমরা এর তদন্ত চাই।” আসানসোলের সিপিএম সাংসদ বংশগোপাল চৌধুরীর অভিযোগ, “রানিগঞ্জের ঘটনায় প্রথমে তৃণমূল পুলিশকে নিষ্ক্রিয় করে রাখার চেষ্টা করেছে। এখন পুলিশ দিয়ে জনরোষ দমানোর চেষ্টা হচ্ছে।” |
রানিগঞ্জে ধর্ষণের প্রতিবাদে কার্জন গেটে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিবাদ। |
বাড়িতে ঢুকে পুলিশের তাণ্ডবের কথা মানতে চাননি পুলিশ কমিশনার অজয় নন্দ। তবে তিনি বলেন, “যারা আইন নিজের হাতে তুলে নিতে চেয়েছে পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেবেই।” ধর্ষণে অভিযুক্তদের পুলিশি হেফাজতে না নেওয়ার ব্যাপারে তাঁর যুক্তি, “ওই কিশোরীর ডাক্তারি পরীক্ষা ও গোপন জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। অভিযুক্তদেরও ডাক্তারি পরীক্ষা হয়ে গিয়েছে। তাই আর হেফাজতে নেওয়ার প্রয়োজন ছিল না।”
|