|
|
|
|
কয়লা খনি বণ্টন মামলা |
সুপ্রিম কোর্টের তিরস্কারে মুখ পুড়ল কেন্দ্রের |
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি |
রাজনীতিকদের কবল থেকে সিবিআই-কে ‘মুক্ত’ করতে চেয়ে রাজনীতির অলিন্দে তোলপাড় তুলে দিল সুপ্রিম কোর্ট। কয়লা কেলেঙ্কারির তদন্ত নিয়ে আজ কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে নজিরবিহীন ভাবে ভর্ৎসনা করল শীর্ষ আদালত। অভিযোগ তুলল বিশ্বাসভঙ্গের। সুপ্রিম কোর্টের মন্তব্যে এক দিকে কেন্দ্রীয় সরকার যখন চরম অস্বস্তিতে, উল্টো দিকে বিরোধীরা তখন উল্লসিত। যদিও এর পরেও সিবিআই-কে রাজনীতির ছোঁয়াচমুক্ত করা যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় পুরোপুরি যাচ্ছে না সংশ্লিষ্ট মহলের।
কয়লা কেলেঙ্কারি নিয়ে তদন্ত করে সিবিআই-কে বন্ধ খামে হলফনামা পেশ করার নির্দেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। যে নির্দেশের উদ্দেশ্য ছিল, তদন্তের গোপনীয়তা ও নিরপেক্ষতা রক্ষা করা। কিন্তু আদালতের সেই নির্দেশ না মেনে হলফনামা পেশের আগেই কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী অশ্বিনী কুমার ও প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের দুই যুগ্ম-সচিবকে রিপোর্টটি দেখান সিবিআই প্রধান রঞ্জিত সিন্হা। আজ সেই প্রসঙ্গে শুনানিতেই সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি আর এম লোঢার নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ বলে, “এ হল এক গভীর বিশ্বাসভঙ্গের ঘটনা! সিবিআইয়ের উপর আস্থার সার্বিক অবক্ষয়ের নিদর্শন। আমাদের প্রথম কাজই হবে রাজনৈতিক প্রভুদের হাত থেকে সিবিআই-কে মুক্ত করা।”
সর্বোচ্চ আদালতের এই পর্যবেক্ষণ মনমোহন সিংহের সরকারকে আজ শুধু বেআব্রু করে দেয়নি, বরং সামগ্রিক ভাবে সিবিআই তদন্তের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। কেননা ‘দিল্লি স্পেশ্যাল পুলিশ এস্টাব্লিশমেন্ট আইনের’ আওতায় ঠিক অর্ধশতাব্দী আগে যে প্রতিষ্ঠানকে নিরপেক্ষ ও স্বাধীন তদন্ত সংস্থা হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল, আজ তাদেরই আদালত নির্দেশ দিয়েছে, ৬ মে-র মধ্যে ‘খোলাখুলি এবং সত্যি’ রিপোর্ট পেশ করতে হবে!
রাজনীতির নাগপাশ থেকে সিবিআই-কে মুক্ত করার জন্য আদালতের এই ফরমান স্বাভাবিক ভাবেই অস্ত্র দিয়েছে বিরোধীদের হাতে। যদিও তারা ক্ষমতায় থাকাকালীন একই ভাবে সিবিআইয়ের হাত-পা বেঁধে রেখেছিল বলেই অভিযোগ। সিবিআই-কে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার অভিযোগ নিয়ে ইন্দ্রকুমার গুজরাল সরকারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিল সীতারাম কেশরীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস। তার আগে সরকারের অঙ্গুলিহেলনে তদন্তের অভিযোগে চন্দ্রশেখরের সরকারের উপর থেকে সমর্থন তুলে নিয়েছিল কংগ্রেস। আবার তাজ করিডর মামলায় বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে সিবিআই-কে ব্যবহার করার অভিযোগ তুলেছিলেন মায়াবতী। মজার বিষয় হল, সেই একই অভিযোগ নিয়ে এখন কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সরব মায়া-মুলায়ম উভয়েই! এমনকী মায়া-মুলায়মের বিরুদ্ধে তদন্তে সিবিআইয়ের একেক বার একেক রকম অবস্থান নিয়েও সম্প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেছে সর্বোচ্চ আদালত।
তবে সিবিআইয়ের উপর রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে এই প্রথম এতটা খড়্গহস্ত হল সুপ্রিম কোর্ট। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামগ্রিক ভাবে যখন সমাজ অসহিষ্ণু হচ্ছে, অণ্ণা হজারের পালে হাওয়া লেগে দেশ জুড়ে মোমবাতি মিছিল হচ্ছে, তখন মানুষের আকাঙ্খা পূরণে সক্রিয় হল আদালত।
আদালতের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙা সঙ্গত বলেই জানাচ্ছেন বিরোধীরা। কেননা সিবিআইয়ের আইনজীবী গোড়ায় আদালতে জানিয়েছিলেন, তাদের তদন্ত রিপোর্ট সরকারকে দেখানোর কোনও প্রশ্নই নেই। আবার সেই কৌঁসুলিই পরে জানান যে, সিবিআই প্রধান তাঁর রাজনৈতিক প্রভুদের খসড়া রিপোর্ট দেখিয়েছিলেন। আদালতে সিবিআইয়ের বক্তব্য থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, তদন্ত রিপোর্ট যাতে সরকারের বিরুদ্ধে না যায়, তা সুনিশ্চিত করতে কসুর করেননি কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়। কয়লা কেলেঙ্কারির তদন্তে পরতে পরতে এমন অনিয়ম দেখেই আজ সাতটি সওয়ালে সরকার ও সিবিআই-কে কোণঠাসা করে দেন বিচারপতিরা। তাঁদের বক্তব্য, ৮ মার্চের শুনানিতে সিবিআই কেন গোপন করল যে, খসড়া রিপোর্ট সরকারকে দেখানো হয়েছে? কেনই বা তার পরের শুনানিতেও আদালতকে সে কথা জানানো হল না? কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের দুই যুগ্ম-সচিব ছাড়া আর কাকে ওই রিপোর্ট দেখানো হয়েছে, রিপোর্টে কী কী পরিবর্তন করা হয়েছে এবং তা কার নির্দেশে করা হয়েছে তা-ও জানতে চেয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। তা ছাড়া, কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী আদৌ সিবিআই প্রধানকে এ ভাবে ডাকতে পারেন কি না সেই প্রশ্ন তুলে শীর্ষ আদালত বলেছে, সেটা যদি তাঁর অধিকারে না থাকে, তা হলে এই ঘটনা কি আস্থার অবক্ষয়ের পরিচায়ক নয়?
আদালতের এই তিরস্কারে আজ চরম অস্বস্তিতে পড়ে যান সরকারের শীর্ষ নেতারা। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ জানান, আদালতের রায় বিবেচনা করে সরকার তার অবস্থান জানাবে। আর কংগ্রেস নেতৃত্ব কার্যত মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন। শত প্রশ্নের জবাবে কংগ্রেসের নেতারা শুধু বলেন, আদালতের রায়ের ওপর মত প্রকাশ করা কংগ্রেসের রীতি নয়। সরকার যখন এতটাই বিপাকে, তখন অস্বস্তি বাড়িয়ে তোলেন স্বয়ং সিবিআই প্রধান। সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ নিয়ে প্রশ্নের জবাবে রঞ্জিত সিন্হা বলেন, “আমি সরকারেরই অংশ! কোনও স্বশাসিত সংস্থা নই। আমি দেশের আইনমন্ত্রীকে রিপোর্ট দেখিয়েছি, বাইরের কাউকে নয়।” সিবিআই প্রধানের এই মন্তব্য নিয়ে নতুন করে বিতর্ক তৈরি হয়। শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যায় ফের বিবৃতি জারি করে সিবিআই প্রধান বলেন, “আমি আসলে বলতে চেয়েছি যে সিবিআই সরকারি ব্যবস্থার একটা অঙ্গ। তাই কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য বিভিন্ন সময়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মত নিতে হয়।”
স্বাভাবিক ভাবেই কংগ্রেস তথা সরকারের এই দুর্দশা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেন বিরোধীরা। রাজ্যসভায় বিরোধী দলনেতা অরুণ জেটলি বলেন, “সিবিআইয়ের অপব্যবহার নিয়ে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে হামেশাই যে অভিযোগ ওঠে, সেটাই আজ প্রমাণিত হয়ে গেল।” তাঁর কথায়, সিবিআইয়ের স্বায়ত্তশাসন ও নিরপেক্ষতার লক্ষ্যে লোকপাল বিল নিয়ে আলোচনায় একগুচ্ছ প্রস্তাব দিয়েছিল বিজেপি। কিন্তু তার একটা সুপারিশও সরকার মানেনি।” বিজেপি নেতৃত্বের বক্তব্য, সিবিআইয়ের কৌঁসুলি নিয়োগের প্রক্রিয়ারও পরিবর্তন করতে হবে। কারণ দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে সরকারের তরফে সিবিআইয়ের জন্য কৌঁসুলি নিয়োগ করা হচ্ছে। তৃণমূল সাংসদ ডেরেক ও ব্রায়েন বলেন, “এখন স্পষ্ট যে, দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের একজনই আস্থাভাজন শরিক রয়েছে। তা হল সিবিআই! আদালতের আজকের পর্যবেক্ষণ ইউপিএ সরকারের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দিল।” সিবিআই তদন্তে সরকারের হস্তক্ষেপ নিয়ে আজ কংগ্রেসের তীব্র সমালোচনা করেছেন বামেরাও। একই সঙ্গে সিপিএম পলিটব্যুরো নেতা সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, “তৃণমূল সর্বোচ্চ আদালতের আজকের পর্যবেক্ষণকে ঢাল করে লগ্নি সংস্থা কেলেঙ্কারিতে সিবিআই তদন্ত এড়াতে চাইছে ঠিকই। কিন্তু এর পরেও আমরা সারদা-কাণ্ডে সিবিআই তদন্ত চাইব। সেই সঙ্গে এ-ও চাইব যে, ওই তদন্ত আদালতের তত্ত্বাবধানে হোক।”
সার্বিক এই পরিস্থিতিতে রাজনীতির কারবারিদের অনেকে অবশ্য এ-ও মনে করছেন, আদালতের এই পর্যবেক্ষণ সত্ত্বেও সিবিআই-কে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা কষ্টসাধ্য বিষয়। কেননা তাতে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে সেই রাজনীতিই।
|
এই সংক্রান্ত খবর...
পুলিশি তদন্তেও বরাবর খবরদারিই রেওয়াজ
|
 |
সরকারকে তথ্য সরবরাহ এক গুরুতর বিশ্বাসভঙ্গ। গোটা তদন্ত প্রক্রিয়ার
ভিত নড়ে গিয়েছে। সিবিআই রাজনৈতিক প্রভুদের কথা শুনতে বাধ্য নয়।
সিবিআইকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করাই আমাদের প্রথম কাজ।
সুপ্রিম কোর্ট |
|
 |
সুপ্রিম কোর্টে এই ধাক্কা সরকারের প্রাপ্যই ছিল। ইউপিএ সরকার তার নিজের আইন মন্ত্রককে হেয় করেছে। ফলে আজ সেই মন্ত্রকই সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলল।
অরুণ জেটলি
রাজ্যসভার বিরোধী নেতা |
|
 |
সিবিআই যে সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গে পরিণত হচ্ছে তা আমরা অনেক দিন ধরেই বলছি। সুপ্রিম কোর্টের মন্তব্যে সেটাই প্রমাণিত হয়েছে। এতে দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।
সীতারাম ইয়েচুরি
সিপিএম পলিটব্যুরো সদস্য |
|
 |
আমরা সরকারের অঙ্গ। কোনও স্বশাসিত সংস্থা নই। আমি দেশের আইনমন্ত্রীকে রিপোর্ট দেখিয়েছি, বাইরের কাউকে নয়। পুরো পরিস্থিতি কোর্টকে জানিয়েছি। কোর্টের নির্দেশ মেনে নেব।
রঞ্জিত সিন্হা
সিবিআই ডিরেক্টর |
|
 |
নির্বাচন কমিশনের মতো সিবিআইকে স্বশাসিত সংস্থা না করলে এই জিনিস চলবেই। নিরপেক্ষ থেকে বিচারব্যবস্থার অধীনে সিবিআইকে কাজ করতে হবে।
উপেন বিশ্বাস
প্রাক্তন যুগ্ম অধিকর্তা, সিবিআই |
|
|
|
 |
|
|