সপাটে চড়। সঙ্গে লাথি। মার খেয়ে হাসপাতালের কর্তব্যরত নার্সদের কেউ লুকোনোর চেষ্টা করছেন। কেউ বা ছুটছেন।
রবিবার সকালে এমনই বেনজির তাণ্ডবের সাক্ষী রইল সিউড়ি সদর হাসপাতাল। চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ তুলে বীরভূমের এ দিন মুখে মুখে কালো কাপড় বেঁধে হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগে ঢুকে পড়ে কর্তব্যরত নার্সদের মারধর করল জনা পনেরো দুষ্কৃতী। ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয় হাসপাতালের সহকারী সুপার জয়দেব নায়েকের ঘরে। পুলিশ এসে লাঠি চালিয়ে ওই দুষ্কৃতীদের ছত্রভঙ্গ করে। তিন জন নার্স আহত হয়ে ওই হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন। বীরভূমের পুলিশ সুপার মুরলীধর শর্মা বলেন, “ইতিমধ্যেই তিন জনকে ধরা হয়েছে। ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হচ্ছে।” স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলেন, “যা ঘটেছে, তা দুর্ভাগ্যজনক। ওই হাসপাতালের নিরাপত্তা নিয়ে আজ, সোমবার স্বাস্থ্যসচিব ও জেলাশাসকের সঙ্গে কথা বলব।” |
হাসপাতাল সূত্রে খবর, এ দিন সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ ওই দুষ্কৃতীরা প্রথমে জয়দেববাবুর ঘরে ভাঙচুর চালিয়ে ঢুকে পড়ে প্রসূতি বিভাগে। সেখানে তিন জন নার্স কাজ করছিলেন। আক্রান্ত মধুমিতা সাহা, অঞ্জলি সরকার ও মুনমুন সরেন বলেন, “কোনও কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওরা আমাদের মারতে শুরু করে। চড়-থাপ্পড়-লাথি কিছুই বাদ দেয়নি।” ওই ওয়ার্ডে কর্তব্যরত চিকিৎসক সব্যসাচী ভৌমিক দুষ্কৃতীদের আটকাতে গেলে তাঁকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া হয়। আতঙ্কিত হয়ে পড়েন ওয়ার্ডে ভর্তি রোগিণীরা। ঘটনার প্রতিবাদে নার্সরা বিকেল ৩টে থেকে ভারপ্রাপ্ত সুপারের ঘরে অবস্থান করছেন। তাঁদের প্রশ্ন, মহিলা ওয়ার্ডে ‘ভিজিটিং আওয়ার’-এর বাইরে কী ভাবে এতগুলো লোক বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমের কিছু প্রতিনিধিকে নিয়ে ঢুকলেন? নিরাপত্তার ব্যাপারে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন, তা-ও তাঁরা জানতে চান। তাঁদের অভিযোগ, তাণ্ডবের সময় হাসপাতালের নিরাপত্তরক্ষীরা নীরব দর্শকের ভূমিকা নিয়েছিল। |
এক জন নার্সকে মারধর করছে রোগীর বাড়ির লোক। রবিবার।—নিজস্ব চিত্র। |
এ দিন জেলার বাইরে ছিলেন হাসপাতাল সুপার মানবেন্দ্র ঘোষ। ভারপ্রাপ্ত সুপার সুশান্ত মাঁকড় বলেন, “মহিলা বিভাগের ইমার্জেন্সি অফিসে এসে ওই দুষ্কৃতীরা স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ সাক্ষীগোপাল মুখোপাধ্যায়ের খোঁজ করছিল। তাদের অভিযোগ ছিল, ওই চিকিৎসকের গাফিলতিতে এক প্রসূতির যমজ সন্তানের মধ্যে এক জনের মৃত্যু হয়েছে। ওরা বলছিল, তার জেরেই এই হামলা।” হাসপাতাল সূত্রের খবর, গত বৃহস্পতিবার এখানে ভর্তি হয়েছিলেন সিউড়ির পাঁচপাকুড় গ্রামের প্রসূতি হালিমা বিবি। হামলাকারীরা অভিযোগ করছিল, অস্ত্রোপচার করে হালিমা বিবির প্রথম শিশুটিকে প্রসব করানো হয়। |
চিকিৎসায় গাফিলতির নামে রবিবার সিউড়ি সদর হাসপাতালে চলল
ভাঙচুর। মারধর করা হল নার্সদেরও। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়। |
গর্ভে তখন আরও একটি শিশু থাকা সত্ত্বেও সে সব না দেখেই অস্ত্রোপচারের জায়গায় সেলাই করে দেওয়া হয়। পরে ফের সেই সেলাই কেটে দ্বিতীয় শিশুটিকে প্রসব করানো হয়। যদিও রবিবার পর্যন্ত এ ব্যাপারে রোগিণীর বাড়ির তরফে কোনও অভিযোগ হয়নি হাসপাতালে। এই অভিযোগটিকে ‘গুজব’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন সুশান্তবাবু। তাঁর দাবি, “অস্ত্রোপচার করে নয়, হালিমা বিবি ওই দিন স্বাভাবিক ভাবেই দু’টি সন্তান প্রসব করেছিলেন। জন্মের কিছু পরেই একটি শিশু মারা যায়। দু’টি শিশু জন্ম দেওয়ায় পরে ওই মহিলার প্রসবদ্বার ছিঁড়ে যাওয়ায় তা সেলাই করা হয়েছিল। শনিবার ওই মহিলা তাঁর সুস্থ সন্তান নিয়ে বাড়ি যান।” |
প্রসূতি বিভাগে ভাঙচুর। মারধরে অসুস্থ
এক নার্স। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়। |
একই কথা জানান সাক্ষীগোপালবাবু। সুশান্তবাবুর আরও দাবি, “চক্রান্ত করে এই হামলা ঘটানো হয়েছে। কেউ হাসপাতালের পরিবেশকে অস্থির করতে চেয়েছে।” হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের প্রশ্ন, কোথাও অভিযোগ না করে প্রসবের তিন দিন পরে হঠাৎ হাসপাতালে কেন হামলা হল? কেনই বা হামলাকারীরা মুখ ঢেকে এসেছিল? এর থেকেই স্পষ্ট পরিকল্পিত ভাবে হামলা হয়েছে।
পুলিশ ঘটনাস্থল থেকেই হালিমা বিবির স্বামী মহম্মদ মহিউদ্দিন-সহ তিন জনকে ধরে। আজ, সোমবার তাঁদের সিউড়ি আদালতে হাজির করা হবে। |