|
|
|
|
টাকা নিয়েছেন পাঁচ মন্ত্রী-নেতা, তোপ সুদীপ্তের
শিবাজী দে সরকার ও কাজল গুপ্ত |
সিবিআই-কে লেখা চিঠিতে নিজের ব্যবসার ভরাডুবির জন্য শাসক দল তৃণমূলের দুই সাংসদ-সহ কয়েক জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন সারদা গোষ্ঠীর কর্ণধার সুদীপ্ত সেন।
এ বার পুলিশি জেরায় সরাসরি শাসক দলের পাঁচ নেতা-মন্ত্রীর দিকে আঙুল তুললেন তিনি। তাঁর অভিযোগ, ওই পাঁচ নেতা-মন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে তাঁর কাছ থেকে টাকা এবং অন্যান্য সুবিধা নিয়েছেন। কারা ওই পাঁচ জন, সেই বিষয়ে মুখ খুলতে রাজি নয় পুলিশ।
বিধাননগর কমিশনারেটের এক কর্তা জানান, নামগুলোর ব্যাপারে নিশ্চিত হতে সিবিআই-কে লেখা চিঠির অংশবিশেষ ধরে জেরা করা হতে পারে সারদা-প্রধানকে। চিঠির সেই দুই সাংসদের নাম জেরার মুখেও সুদীপ্তবাবু বলেছেন কি না, তা নিয়ে জল্পনা চলছে প্রশাসনের অন্দরে।
পুলিশি সূত্র জানাচ্ছে, নেতা-মন্ত্রীদের সঙ্গে সঙ্গে নিজের সংস্থার কয়েক জন পদস্থ কর্তার বিরুদ্ধেও অভিযোগ করেছেন সুদীপ্তবাবু। এ রাজ্যের কিছু রাজনৈতিক নেতার পাশাপাশি ভিন্ রাজ্যের এক প্রভাবশালী ব্যক্তির কথাও উঠে এসেছে জেরায়। পুলিশ জেনেছে, ওই ব্যক্তি উত্তর-পূর্বাঞ্চলের দু’টি রাজ্যে সারদার ব্যবসা বিস্তারে বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন। এক পুলিশকর্তার কথায়, “অসম ও ত্রিপুরায় ব্যবসার ব্যাপারে ছায়াসঙ্গিনী দেবযানী মুখোপাধ্যায়ের থেকেও ওই ব্যক্তিকে বেশি গুরুত্ব দিতেন সুদীপ্তবাবু।” বিধাননগরের তদন্তকারীরা তো বটেই, অসম পুলিশের বিশেষ দলও ওই ব্যক্তির কথা জানতে পেরেছে। রবিবার গুয়াহাটি থেকে আসা অসম পুলিশের দলটি নিউ টাউন থানায় সুদীপ্ত-দেবযানীকে জেরাও করেছে।
সারদা-সাম্রাজ্য কী ভাবে চলত, তিন দিনের জেরাতেই তার কিছুটা আভাস মিলেছে বলে তদন্তকারীদের দাবি। তাঁরা জেনেছেন, দু’ভাগে ব্যবসা পরিচালনার কাজ করছিলেন সুদীপ্তবাবু। পশ্চিমবঙ্গ, অসম ও ত্রিপুরায় ব্যবসা দেখতেন তিনি নিজে। আর ঝাড়খণ্ড, মুম্বই, পোর্ট ব্লেয়ার-সহ বিভিন্ন জায়গায় ব্যবসা দেখভালের দায়িত্ব ছিল দেবযানী এবং অরবিন্দ সিংহ চৌহানের উপরে। পুলিশের অনুমান, যেখানে লাভের অঙ্ক বেশি, সে-সব ক্ষেত্রে সুদীপ্তবাবু নিজে হাজির হতেন। সেই কারণেই নিজের রাজ্য আর অসম-ত্রিপুরায় থাকতেন বেশি। অন্যান্য জায়গায় এক-এক বারের বেশি তাঁর উপস্থিতির প্রমাণ পায়নি পুলিশ। তারা জেনেছে, দেবযানী ক্রমশই এ রাজ্যে এজেন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াচ্ছিলেন। সেই সংযোগ কতটা গভীর ছিল, তার খোঁজখবর নিতে পুলিশের একটি দল যাচ্ছে বর্ধমান, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ায়।
তবে পূর্বাঞ্চলের তিনটি রাজ্যের বাইরে সুদীপ্তবাবু নিজের ব্যবসার কিছু জানতেন না, এ কথাও মানতে রাজি নন তদন্তকারীরা। পুলিশেরই একটি সূত্র জানাচ্ছে, সারদার টাকাপয়সার ব্যাপারে কর্ণধারই শেষ কথা বলতেন। জেরায় জানা গিয়েছে, দক্ষিণবঙ্গের কয়েকটি জেলায় টাকা তোলার ব্যাপারে মনোজ নেগেলকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন তিনি। দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে মাসে ১২-১৫ কোটি টাকা তুলতেন নেগেল। প্রতিদানও পেতেন। লক্ষাধিক টাকা বেতনের সঙ্গে সঙ্গে সংস্থা থেকে দামি গাড়িও দেওয়া হয়েছিল তাঁকে।
তদন্তকারীদের একটি সূত্রের খবর, পুরনো ৩৪টি গাড়ির পাশাপাশি কয়েক মাস আগে ৪২টি নতুন গাড়ি কিনেছিলেন সুদীপ্তবাবু। সংস্থার আর্থিক হাল খারাপ হওয়া সত্ত্বেও বদলাননি জীবনযাপনের মান। এক তদন্তকারী অফিসারের কথায়, “খরচে বিধিনিষেধ নিয়ে হিসাবরক্ষকের বক্তব্যকে আমল দেননি কর্ণধার।”
জেরায় ওই ভুঁইফোঁড় লগ্নি সংস্থার অভ্যন্তরীণ কিছু গোলমালের কথাও উঠে এসেছে। এক পুলিশকর্তা জানান, সফ্টওয়্যারে গোলমালের ব্যাপারটি জানার পরেই বোর্ড মিটিং ডেকেছিলেন সারদা-প্রধান। সেখানে বিষয়টি নিয়ে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয় বলে সুদীপ্তবাবু জেরায় জানিয়েছেন।
রবিবার ধৃতদের জেরার উপরে তেমন জোর দেওয়া হয়নি। তবে সন্ধ্যায় নিউ টাউন থানায় গিয়ে সুদীপ্ত-দেবযানী-অরবিন্দকে জেরা করেন বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার ও গোয়েন্দা-প্রধান অর্ণব ঘোষ। জেরায় সুদীপ্তবাবু জানান, সংস্থার বিভিন্ন শাখার সব টাকা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা পড়ত। তদন্তকারীরা সেই সব মিলিয়ে হিসেব পেতে চাইছেন। হিসেব মিলছে কি? অর্ণববাবু জানান, ব্যাঙ্ক-বিবৃতি না-পেলে এ ব্যাপারে নিশ্চিত ভাবে কিছু বলা যাবে না। বিধাননগর কমিশনারেটের খবর, আজ, সোমবার থেকে অ্যাকাউন্টের হিসেব রাখার জন্য একটি পৃথক ‘সেল’ তৈরি করা হচ্ছে। ‘সেল’ তৈরি হচ্ছে সারদা সম্পর্কে অভিযোগ নেওয়ার জন্যও।
সুদীপ্ত-দেবযানীর কোঁসুলিরাও এ দিন নিউ টাউন থানায় যান। তাঁদের বক্তব্য, সারদা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ঠিক কী কী, তাঁরা সেগুলো জানতে চান। তা হলে তাঁরাও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারবেন।
গোয়েন্দারা এ দিন সারদার দুই পদস্থ কর্মীকে নিয়ে ওই গোষ্ঠীর মিডল্যান্ড পার্কের অফিসে তল্লাশি চালান। সেখানে প্রচুর সিডি, হার্ড ডিস্ক ও নথি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। খোঁজ নেওয়া হয়েছে সংস্থার বিভিন্ন শাখার আমানত ও এজেন্টদের সম্পর্কে। এক পুলিশকর্তা জানান, ওই অফিসে এজেন্টদের যাতায়াত ছিল। টাকা আদায়ও করা হত।
শিলিগুড়ির উপকণ্ঠে মিলনমোড় কড়াইবাড়ি এলাকায় লিঙ্কনস হাইস্কুলটি পুরনো মালিকের কাছ থেকে কিনে নিয়েছিল সারদা গোষ্ঠী। সুদীপ্তবাবু ধরা পড়ার পরে ওই স্কুলের ব্যাঙ্ক আমানত ‘ফ্রিজ’ করে দেওয়া হয়েছে। বিপাকে পড়েছেন স্কুলের শিক্ষক-কর্মীরা। স্কুলের ১৫০০ পড়ুয়া এবং তাদের অভিভাবকেরাও উদ্বিগ্ন। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব এ দিন বলেন, “এতগুলি ছাত্রছাত্রীর ভবিষ্যৎ জড়িয়ে রয়েছে স্কুলটির সঙ্গে। বিষয়টি স্পর্শকাতর। কলকাতায় গিয়ে বিষয়টি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলব। সরকার নিশ্চয়ই গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি দেখবে।” |
তথ্য সহায়তা: আর্যভট্ট খান |
|
|
|
|
|