পুরনো ধারায় নতুন আইন
দেরি হবে বিচারে, বলছেন বিরোধীরা
খামতি কমিয়ে আরও কঠোর বিল তৈরি করার কথা বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী নিজেই। সে জন্য রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে বাম আমলের বিল ফিরিয়ে না এনে পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হয়। ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থার আমানতকারীদের স্বার্থরক্ষায় আগামিকাল, সোমবার বিধানসভায় নতুন বিল পেশ করতে চলেছে সরকার। তার আগে এ দিন তার প্রতিলিপিও বিলি করা হয়েছে। কিন্তু বিলটি দেখার পরে বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছেন, আদৌ কি নতুন বিলটি নতুন কিছু দিতে পারবে?
নতুন বিলটিতে নতুন কী আছে? সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই বিলে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা যাবে (আগের বিলে আটক করার ক্ষমতা ছিল)। দ্বিতীয়ত, এই বিলে সন্দেহভাজনের বাড়ি বা অফিসে দরজা, বাক্স, লকার, আলমারি বা সিন্দুকের তালা ভেঙে তল্লাশির অধিকার রয়েছে। বিরোধীদের অভিযোগ ছিল, সারদা-কাণ্ডের অভিযুক্তদের ছাড় দিতেই পুরনো বিল প্রত্যাহার করে নতুন বিল আনছে সরকার। জবাবে সরকার বলেছিল, নতুন বিলে আগের ঘটনাকে যুক্ত করা হবে (অর্থাৎ রেট্রোস্পেকটিভ এফেক্ট রাখা হবে)। বিলের ২১ নম্বর ধারায় সেটাই স্পষ্ট করার চেষ্টা হয়েছে। বলা হয়েছে, আগের বিভিন্ন কমিশন যে সব সুপারিশ করেছে, তা এই বিলের আওতায় আসবে এবং কার্যকর করা যাবে। একেই ‘রেট্রোস্পেকটিভ এফেক্ট’ বলছেন সরকারের শীর্ষকর্তারা। এ ব্যাপারে শাসক দলেরও বক্তব্য, প্রাক্তন বিচারপতি শ্যামল সেন নেতৃত্বাধীন কমিশন সারদা-কাণ্ডে যে রিপোর্ট দেবে, তা নতুন আইনে বিচার করা হবে।
বিরোধীরা কিন্তু বলছেন, নতুন বিলে নতুন কিছুই নেই। বরং একাধিক এমন বদল করা হয়েছে যাতে উল্টে প্রতারিতদের হয়রানি বাড়বে। দীর্ঘসূত্রী হবে বিচার প্রক্রিয়া। বিরোধীদের তাই বক্তব্য, যে সামান্য তফাত আছে আগের বিলের সঙ্গে সেটা ওই বিলেই সংশোধন করে দেওয়া যেত। তাতে ২০০৯ সাল থেকে এই সংক্রান্ত সব ফৌজদারি অপরাধ চলে আসত বিলের আওতায় আর সুদীপ্ত সেনের গলায় ফাঁস আঁটাও সম্ভব হত। নতুন বিলটিকে ‘চোখে ধুলো দেওয়া’ বলে মন্তব্য করেছেন প্রাক্তন স্পিকার হাসিম আব্দুল হালিম। তিনি বলেন, “২০০৯ সালে যে বিল আনা হয়েছিল, তার সঙ্গে প্রস্তাবিত নতুন বিলে বিশেষ ফারাক নেই। কিছু ক্ষেত্রে শব্দ বদল এবং পুরনো বক্তব্যকে ভেঙে বিস্তারিত করা হয়েছে বা ছোট করা হয়েছে।”
প্রশ্ন উঠেছে রেট্রোস্পেকটিভ এফেক্ট নিয়ে। কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়া বলেছেন, “রেট্রোস্পেকটিভ এফেক্ট দেওয়ার বিষয়টি কি সংবিধানের ২০ ধারার পরিপন্থী নয়? নতুন আইন পাশের আগে কেউ যদি কোনও অপরাধ করে, আগামী দিনের পাশ করা নতুন আইন দিয়ে অতীতের অপরাধীর শাস্তি হতে পারে কি?” হাসিম আব্দুল হালিমও বলেন, “সংবিধানের ২০ ধারায় বলা হয়েছে, যখন অপরাধ সংগঠিত হয়েছে, তখন ওই বিষয়ে যে আইন ছিল তা-ই কার্যকর হবে। ফলে, নতুন আইন করা হলেও সারদা কাণ্ডে অভিযুক্তদের নতুন আইনের আওতায় আনা যাবে না।” তাঁর বক্তব্য, বরং আগের বিলটিতে সংশোধনী আনলে ঠিকঠাক কাজ হত।
রেট্রোস্পেকটিভ এফেক্ট নিয়ে সংশয় রয়েছে প্রশাসনিক মহলেও। গত বুধবার মুখ্যমন্ত্রী মহাকরণে আইন তৈরির কথা ঘোষণা করার আগে সম্ভাব্য আইনটির খুঁটিনাটি নিয়ে স্বরাষ্ট্র, আইন ও অর্থ বিভাগের অফিসারদের বৈঠক হয়। সেখানেই তাঁদের জানানো হয়, মুখ্যমন্ত্রী চান, সারদা তো বটেই, তার আগেও এ ধরনের জালিয়াতির যে সব ঘটনা ঘটেছে, সে সবই এই আইনে ধরতে হবে। এই কথা শুনে আপত্তি জানান স্বরাষ্ট্র ও আইন দফতরের অফিসারদের অনেকেই। তাঁদের বক্তব্য, এ ভাবে নতুন বিলে পুরনো মামলা টানা যায় না।
তার পরেও শাসক দল কিন্তু নিজেদের অবস্থান থেকে সরছে না। আগের বিলের থেকে এই বিল কোন দিকে বেশি কঠোর, এই প্রশ্নের জবাবে শাসক দলের এক শীর্ষস্থানীয় নেতা ২১ ধারার উল্লেখ করে জানিয়েছেন, আগের কমিশনগুলির সুপারিশও এই আইনের আওতায় আসবে। শাসক দলের একটি বড় অংশ বলছে, নতুন ধারা সংযোজন করে সারদা-কাণ্ডের বিচারের দরজাও খুলে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। একই সঙ্গে তাঁদের বক্তব্য, আগের আইনে শুধু সম্পত্তি আটক করার কথা বলা হয়েছিল। এ বারে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার সুযোগ থাকছে। সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হলে প্রতারিতদের টাকা ফেরতের ব্যবস্থাও করা যাবে। যেটা ‘আটক’ করা হলে সম্ভব নয়। এর জবাবে বিরোধীদের বক্তব্য, এটুকু তো পুরনো আইন সংশোধন করেই দেওয়া যেত। তার জন্য নতুন আইন করার দরকার কী?
বিরোধীদের আরও অভিযোগ, নতুন বিল বিচার ব্যবস্থাকে দীর্ঘসূত্রী করবে। কেন দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হবে, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মানস ভুঁইয়া বলেছেন, “আগের বিলে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ হিসেবে জেলায় জেলাশাসক ও শহরে পুলিশ কমিশনারকে রাখা হয়েছিল। নতুন বিলে ‘ডিরেক্টর অফ ইকনমিক অফেন্স সেল’-কে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। ফলে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে ক্ষমতা। সবটাই চলে যাচ্ছে এক জন ব্যক্তির হাতে।” এর ফলে এক দিকে যেমন মামলা মিটতে সময় লাগবে, অন্য দিকে গ্রামের লোককে শহরে ছুটে আসতে হবে বলে মনে করছেন বিরোধী নেতৃত্বের একটি বড় অংশ। নতুন বিলে যে ডেজিগনেটেড কোর্ট-এর তদন্ত করার কথা রয়েছে, তা-ও বিচারকে দীর্ঘসূত্রী করবে বলে মনে করেন মানসবাবু। তাঁর মতে, এটাই বিলের প্রধান খামতি। তবে সম্পত্তি আটকের বদলে বাজেয়াপ্ত করার দিকটি সদর্থক বলে মনে করেন তিনি।
অন্য দিকে, বামফ্রন্টের বৈঠকের পরে ফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুর অভিযোগ, “নতুন বিল এনে তদন্তের কাজে দেরি করিয়ে দিতে চায় রাজ্য সরকার, যাতে অভিযুক্ত ছাড়া পেয়ে যায়।” নতুন বিলের ব্যাপারে বামেরা আপত্তি তুলবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্নের জবাবে বিমানবাবু বলেন, “বাম পরিষদীয় দল যা করার করবে।” কী করা হবে, তা ঠিক করতে আজ, রবিবার আলিমুদ্দিনে বৈঠকে বসছেন বাম নেতারা।
নতুন বিলটি পাশ করিয়ে আইন তৈরি করার কাজও সময়সাপেক্ষ বলে অভিযোগ করেছেন বিরোধীরা। বিমানবাবু বলেন, “বিলটি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর পরে তিনি আইন মন্ত্রক, অর্থ মন্ত্রক এবং কোম্পানি মন্ত্রকে বিলের কপি পাঠাবেন। তারা নোট দেওয়ার পরে পুনরায় তা রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে। তার পরে রাষ্ট্রপতি নোট দিয়ে সেটি রাজ্য সরকারের কাছে পাঠাবেন। সব মিলিয়ে অনেক দেরি হবে।”
কিন্তু রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে ২০১০ সালে এই বিল ফেরত আসার পরেও তা নতুন করে বামফ্রন্ট বিধানসভায় পাশ করায়নি কেন? জবাবে বিমানবাবু বলেন, “বামফ্রন্ট দেরি করেছে মানছি। কিন্তু তৃণমূল ক্ষমতায় এসে দু’বছরের মধ্যে তা সংশোধন করে কেন রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাল না?”
শাসক দলের পক্ষে পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এ দিন এই বিল নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তবে তাঁর দাবি, “ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। দ্রুততার সঙ্গে, স্বচ্ছতার সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত আমানতকারীদের সুবিচারের ব্যবস্থা করবে আমাদের সরকার।”
তদন্তের খুঁটিনাটি
• রাজীব কুমারের সঙ্গে দেখা করলেন সিবিআই কর্তা
• বিভিন্ন ব্যাঙ্কের ১০০টি শাখায় ২১০ অ্যাকাউন্ট
• ৪৫০ বিঘা জমি। কয়েকশো গাড়ি
• ত্রিপুরা, অসম, ওড়িশার বালেশ্বরে জমির হদিস
• সুদীপ্ত-সঙ্গী মনোজ নেগেলকে নিয়েও তল্লাশি
নতুন মাত্র ৪
• সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার অধিকার
• দরজা, বাক্স, লকার, আলমারি, সিন্দুক ভেঙে তল্লাশির অধিকার
• উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ ডিরেক্টর অফ ইকনমিক অফেন্স সেল। আগে ছিলেন ডিএম, পুলিশ কমিশনার
• আগের নানা কমিশনের সুপারিশ আওতায় আসবে, অর্থাৎ রেট্রোস্পেকটিভ এফেক্ট থাকছে
পাল্টা যুক্তি
• ডিএম-এর বদলে ডিরেক্টর অফ ইকনমিক অফেন্স সেলের হাতে দায়িত্ব এলে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ হবে। গ্রামের লোককে কলকাতায় আসতে হবে। বিচার দীর্ঘসূত্রী হবে।
• মামলাগুলি ফৌজদারি হওয়ায় সেগুলিতে রেট্রোস্পেকটিভ এফেক্ট কার্যকর হবে না, সংবিধানের ২০ ধারাতেই বলা আছে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.