|
|
|
|
প্রশাসনের রিপোর্টে অভিযুক্তরা কিন্তু শাসক দলেরই নেতা
জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় • কলকাতা
আনন্দ মণ্ডল • তমলুক |
দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষণা, সারদার কারবার তিনি জানতেন না। এই কাণ্ডে তৃণমূলেরও যোগ নেই। দলের মহাসচিব তথা শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও দাবি করেছেন, সারদা-কাণ্ডে দলগত ভাবে জড়িত নয়
তৃণমূল। নেতা-নেত্রী চান বা না চান, রাজ্যবাসী দেখেছেন, ইতিমধ্যেই ওই বিতর্কে জড়িয়েছে তৃণমূল সাংসদ কুণাল ঘোষ এবং সৃঞ্জয় বসুর নাম। আগুনে ঘি ঢালল পূর্ব মেদিনীপুর জেলা প্রশাসনের তরফে মহাকরণে পাঠানো দু’টি রিপোর্ট।
স্বরাষ্ট্র দফতরকে পাঠানো পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পুলিশ সুপার সুকেশ জৈনের রিপোর্টে জানানো হয়েছেজেলার লক্ষ লক্ষ আমানতকারীকে পথে বসিয়ে পলাতক জনা পাঁচেক এজেন্টের নাম (রিপোর্টে রাজনৈতিক পরিচয় লেখা হয়নি)। ঘটনাচক্রে তাঁরা সবাই তৃণমূলের নেতা-কর্মী। অভিযুক্তদের মধ্যে দু’জন আবার তৃণমূলের হয়ে ভোটেও জিতেছেন। পাশাপাশি পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসক পারভেজ আহমেদ সিদ্দিকিও ২৫ এপ্রিল ভুঁইফোঁড় আর্থিক
|
অনন্ত ঘোড়ই |
সংস্থা নিয়ে মহাকরণে পাঠানো রিপোর্টে লিখেছেন, সারদা-কেলেঙ্কারির জেরে জেলার পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ। দ্রুত আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়া না গেলে আইন-শৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কা রয়েছে।
দোষীদের কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না, এই প্রশ্নের জবাবে এসপি সুকেশ জৈন বলেন, মামলায় গ্রেফতার করাটা অগ্রাধিকার নয়। এখন তদন্ত চলছে। তার গতিপ্রকৃতি দেখেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
প্রশাসনিক কর্তারা জানিয়েছেন, শুধু পূর্ব মেদিনীপুর নয়, অন্য জেলাগুলির পরিস্থিতিও একই রকম।
পুলিশ সুপারের রিপোর্টে বলা হয়েছে, মেচেদা, পাঁশকুড়া, এগরা, কাঁথিতে বড় বড় শাখা খুলে সারদা টাকা তুলেছে। ব্যাঙ্কের থেকে অনেক বেশি সুদ দিয়ে এই টাকা তোলা হয়েছে। কোলাঘাটের আমলহাণ্ডার গোপাল দাস, গোপালপুরের তাপসকুমার বাগ ছিলেন সারদার পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মূল এজেন্ট। এঁদের সঙ্গে ছিলেন পাঁশকুড়ার গোপালনগরের অনন্ত ঘোড়ই, এগরার আইলানের মৃত্যুঞ্জয় দাস। তা ছাড়া, কাঁথির তেঁতুলমারি বাসিন্দা অনিল হোতা ছিলেন পূর্ব মেদিনীপুর জেলার সারদার টাকা তোলার মূল পান্ডা। এলাকায় বড় তৃণমূল নেতাদের ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত। এঁরা সকলেই পলাতক।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, এগরার আইলান গ্রামের মৃত্যুঞ্জয় দাস কংগ্রেস ছেড়ে কয়েক বছর আগে তৃণমূলে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি তৃণমূলের বুথ সভাপতি। স্থানীয় রাসন নেহেরু বিদ্যাপীঠের পরিচালন সমিতির সদস্য (পঞ্চায়েত সমিতির মনোনীত প্রতিনিধি)। স্থানীয় কুদি রামকৃষ্ণ সমবায় কৃষি উন্নয়ন সমিতির নির্বাচিত সদস্যও। গত ছ’বছর ধরে তিনি সারদার সঙ্গে যুক্ত। এগরা, মোহনপুর, রামনগর ও সংলগ্ন ওড়িশার বিভিন্ন এলাকায় সংযোগ বাড়িয়ে কয়েক কোটি টাকা তুলে দেওয়ার জন্য সংস্থা থেকে দামি গাড়িও উপহার পান।
মৃত্যুঞ্জয়ের দাবি, “আমি তৃণমূলের এলাকার নেতা। কিন্তু দলের নাম এই পেশায় ব্যবহার করিনি। ব্যক্তিগত বিশ্বাসযোগ্যতা এবং সংস্থাকে দেখে মানুষ টাকা রেখেছেন। কোম্পানির কাছে আমিও প্রতারিত হয়েছি। যা হয়েছে, তার জন্য দুঃখিত। সাধারণ মানুষ যাতে লগ্নি করা টাকা ফেরত পান, তার জন্য আমাদের সরকার ব্যবস্থা নিয়েছে। প্রয়োজনে কোম্পানির বিরুদ্ধে সরকার কঠোরতম ব্যবস্থা নিক।” যদিও আইলান গ্রামের আমানতকারীরা একথা মানছেন না। তাঁদের ক্ষোভ, তৃণমূলের স্থানীয় নেতা হওয়ার প্রভাব মৃত্যুঞ্জয়
এলাকায় খাটিয়েছেন। সততার প্রশ্নে দলনেত্রীকেই তিনি মানদণ্ড করে দেখিয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য, “সেই ভরসার মাসুল এখন দিচ্ছি। আমাদের সমস্ত সঞ্চয় জলে গিয়েছে।” |
নিজের গাড়ির সামনে সারদার এজেন্ট তৃণমূল নেতা মৃত্যুঞ্জয় দাস। |
তমলুকের মূল এজেন্ট অনন্ত ঘোড়ই আবার তাঁর সঙ্গে দলের সম্পর্ক মেনেই নিয়েছেন। পাঁশকুড়ার গোপালনগর গ্রামের বাসিন্দা অনন্তবাবু স্বীকার করেন সারদা গোষ্ঠীর কেলেঙ্কারির জেরে তাঁর ভাবমূর্তি বিপন্ন হয়েছে। আর অনন্তবাবুকে দলের সমর্থক হিসেবে মেনে নিয়ে গোপালনগর গ্রামের পঞ্চায়েত সদস্য প্রশান্ত জানা বলেন, “অনন্তবাবু আমাদের দলের সমর্থক। দলের সমর্থক হিসেবেই হাইস্কুলের পরিচালন সমিতির নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। দলের সিদ্ধান্ত মেনেই ওঁকে সম্পাদক করা হয়েছিল। তবে উনি সারদা গোষ্ঠীর এজেন্ট হিসেবে কাজ করতেন, জানা ছিল না। এখন গ্রামবাসীদের কাছ থেকে জানতে পারছি, অনন্তবাবু সারদাগোষ্ঠীর এজেন্ট হিসেবে টাকা তুলতেন।”
গ্রামীণ চিকিৎসক অনন্তবাবু বলেন, “আড়াই বছর আগে স্থানীয় এক টিম লিডারের কথায় স্ত্রী পম্পার নামে সারদার এজেন্ট হিসেবে কাজ শুরু করেছিলাম। মূলত বাড়িতে আসা আশেপাশের গ্রামের প্রায় ৫৫ জনের কাছ থেকে টাকা তুলেছি। মাসে প্রায় ৯ লক্ষ টাকা জমা দিতাম। সুদীপ্তবাবু (সেন) ও দেবযানী (মুখোপাধ্যায়) মাস দু’য়েক আগে পাঁশকুড়া শাখায় এসেছিলেন।” তাঁর সংযোজন, “সারদাগোষ্ঠীর কেলেঙ্কারির পরে প্রতিদিন বাড়িতে এসে গ্রাহক টাকা ফেরত চাইছে।”
অনন্তবাবুর স্ত্রী পম্পা ঘোড়ইয়ের দাবি, “এজেন্ট হিসেবে সারদা গোষ্ঠীর বিভিন্ন মিটিংয়ে যেতাম। সেখানে সুদীপ্ত সেন ও দেবযানী মুখোপাধ্যায় আসতেন। সুদীপ্তবাবু মিটিংয়ে বলতেন, ‘তৃণমূল সরকার আমাদের সঙ্গে আছে’। মিটিংয়ে বলা হত ‘যেহেতু তৃণমূল সরকার আছে তাই পাঁচ বছর নিশ্চিন্ত থাকুন’। এই কথায় ভরসা করে গ্রামের মানুষকে বুঝিয়ে টাকা তুলতাম। বুঝিনি, আমাদের কত বড় ধাপ্পা দেওয়া হচ্ছে।”
সারদা গোষ্ঠীর মেচেদা শাখার অন্যতম বড় এজেন্ট হিসেবে পরিচিত তাপস বাগ কোলাঘাটের গোপালপুর গ্রামের বাসিন্দা। তাপসবাবুর অধীনে চারশোরও বেশি এজেন্ট কাজ করছিলেন। এলাকায় তৃণমূল সমর্থক হিসেবেই পরিচিত তাপসবাবু। এ দিন বাড়িতে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। তাপসবাবু টেলিফোনে বলেন, “বাড়ির বাইরে আছি। গ্রাহকরা টাকা ফেরত চেয়ে নানা ভাবে চাপ দিচ্ছেন। এমনকী মারধরের হুমকি দিচ্ছেন। নিরাপত্তা চেয়ে আমরা প্রায় ৫০ জন এজেন্ট কোলাঘাট থানায় গিয়েছিলাম। কিন্তু নিরাপত্তার আশ্বাস পাইনি।”
তমলুকের তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী বলেন, “সারদার এজেন্ট হিসবে শুধু আমাদের কেন, সব দলেরই লোক আছে। বামফ্রন্ট আমলে বেকারত্বের জন্য অনেকেই এই সব সংস্থার এজেন্ট হয়ে কাজ শুরু করেছেন। আমাদের দলের তরফে কাউকে সারদার এজেন্ট হতে বলা হয়নি। দল তাঁর দায়ও নেবে না।”
|
সহ প্রতিবেদন: অমিত কর মহাপাত্র, এগরা ছবি: কৌশিক মিশ্র |
|
|
|
|
|