বারো বছরের কারাবাস শেষ। পুত্র ও পুত্রবধূকে নিয়ে দেশে ফিরছেন ধনপতি। তখনই চণ্ডীর আশীর্বাদে নদীর অতল থেকে ভেসে উঠল সদাগরের সাত ডিঙা।
মুকুন্দরামের ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে তা-ও বারো বছরের সময়সীমা ছিল। কিন্তু আধুনিক বাংলায় কোনও সাহিত্য পুরস্কারের অনুষ্ঠানে কত দিন বাদে ভেসে উঠল ‘মঙ্গলকাব্য’, ‘কমলেকামিনী’ বা ‘পলাকড়ি’ শব্দগুলি? ‘ধনপতির সিংহলযাত্রা’ উপন্যাসের জন্য শনিবার সন্ধ্যায় মধ্য কলকাতার পাঁচতারা হোটেলে এক অনুষ্ঠানে ১৪১৯ বঙ্গাব্দের আনন্দ পুরস্কারে সম্মানিত হলেন রামকুমার মুখোপাধ্যায়। সেই অনুষ্ঠানেই পৌরোহিত্য করতে এসে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী উপন্যাসটি সম্পর্কে জানালেন, ‘‘ভাষা নিয়ে চমৎকার পরীক্ষা। বাংলায় বাক্যগঠনের রীতিতে অনেক হারিয়ে-যাওয়া শব্দ ব্যবহার করেছেন রামকুমার। যেমন, পলাকড়ি। মানে, পটল। কিন্তু শব্দটি আজ আর আমরা ব্যবহার করি না।’’ |
রামকুমার মুখোপাধ্যায়ের হাতে ১৪১৯ বঙ্গাব্দের আনন্দ পুরস্কার তুলে দিচ্ছেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।
রয়েছেন আনন্দবাজার পত্রিকার প্রধান সম্পাদক অভীক সরকার। শনিবার। ছবি: দেবাশিস রায়। |
শুধুই হারিয়ে যাওয়া শব্দ? আনন্দবাজার পত্রিকার প্রধান সম্পাদক অভীক সরকার তাঁর ভাষণে হারিয়ে-যাওয়া ইতিহাসের কথাও বলছিলেন, ‘‘সাহেবরা আসার আগে আমরা কী ছিলাম, কেমন ছিলাম, সে বিষয়ে চিন্তা-ভাবনার অভ্যাস বাঙালি প্রায় সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেছে।’’ সাহেবদের শেখানো ইতিহাসের বাইরে বিকল্প চিন্তা যে কত ভাবে ছায়া ফেলেছে রামকুমারবাবুর এই উপন্যাসে! সেখানে গণৎকার খড়িবজ্র খাঁ ধনপতিকে অভিশাপ দেয়, ‘সাগরে ডুবুক সাততরী দেমাক, ভিটায় ঘুঘু চরুক জোড়ায় জোড়ায় আর বোদাল মীনের ঝাল-চচ্চড়ি খা দিনরাত্রি।’ বোদাল, মানে বোয়াল মাছ। ধনপতি দত্ত বা চাঁদ সদাগরের মতো গন্ধবণিকরা ওই মাছ খেতেন না। শুধু ভাষা নয়, প্রাক-ঔপনিবেশিক বাংলার টোটেম, ট্যাবু সবই রয়েছে ওই উপন্যাসে।
এক দিকে টোটেম, ট্যাবু। অন্য দিকে শঙ্খদ্বীপের কথা লেখেন রামকুমার। সেখানকার হাওয়ায় শোনা যায় পঞ্চপাণ্ডবের পাঞ্চজন্য, দেবদত্ত, পৌন্ড্র ইত্যাদি পাঁচটি শাঁখের আওয়াজ। স্বপন চক্রবর্তী তাই মানপত্রে পাঠ করলেন, ‘মহাকাব্যিক বিস্তার ও বাংলা মঙ্গলকাব্যের সরল উপাখ্যানপ্রিয়তা আপনি অন্বিত করেছেন আপনার উপন্যাসে।’ তিনি, বাঁকুড়ার গেলিয়া গ্রামের ছেলে রামকুমার মুখোপাধ্যায় অবশ্য এই পুরস্কার-সন্ধ্যায় নিজের লেখাকে দেখতে চেষ্টা করলেন অন্য ভাবে।
ইতিহাস, মহাকাব্য ইত্যাদি চশমার আড়াল ছেড়ে তিনি জানালেন, ‘ধনপতির সিংহলযাত্রা আমার কোনও মধ্যযুগচর্চা নয়। অতীতগামিতাও নয়। এ হল আমার গাঁ-ঘরে ফেরা।’ নিজের গ্রামকে ভালবেসেই তা হলে উপন্যাসে তিনি বৃন্দাবনের কৃষ্ণের সঙ্গে বাংলার কৃষ্ণের তফাত করে দেন? ‘‘বৃন্দাবনের কানাই পরত কদম্বমালা, আমাদের গাঁ-ঘরের কালা গুঞ্জামালা।’’ গ্রামগঞ্জের সুলপো শাক থেকে ঝিঙেফুল, জেলেডিঙি অনেক কিছুই যে এল মঙ্গলকাব্য-আশ্রিত এই উপন্যাসে। |
আনন্দ পুরস্কার প্রাপকের উদ্দেশে মানপত্র পাঠে স্বপন চক্রবর্তী।— নিজস্ব চিত্র। |
আজকের পৃথিবীতে মঙ্গলকাব্য আদতে প্রাসঙ্গিক? নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বলছিলেন, ‘‘একমাত্র ভারতচন্দ্র ছাড়া অন্য কোনও মঙ্গলকাব্যে গোয়েন্দা লাগিয়েও কবিত্ব জিনিসটা খুঁজে পাওয়া যাবে না।’’ লেখক অবশ্য মঙ্গলকাব্যে কবিত্ব খুঁজলেন না। জানালেন, মনসামঙ্গলের চাঁদ সদাগরের থেকেও চণ্ডীমঙ্গলের ধনপতি তাঁর কাছের। ‘‘সে ক্ষমতাবান নয়, কিন্তু প্রেমিক। সে পায়রা ওড়ায়, প্রেমে পড়ে, নাস্তানাবুদ হয় দুই সতীনের দ্বন্দ্বে,’’ বলছিলেন রামকুমারবাবু। আর সেখানেই মঙ্গলকাব্যের গর্ভে উপন্যাসের জন্ম। মানুষের ছোটখাটো ঈর্ষা, তুচ্ছতা সবই চলে আসে সেখানে। দেবদেবীরাও তার ব্যতিক্রম নন। মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলকাব্যে পদ্মাবতী চণ্ডীর সখী। কিন্তু রামকুমারের উপন্যাসে এই পদ্মাবতী হয়ে গেলেন চণ্ডীর কন্যা এবং সর্পবাহনা মনসা। চণ্ডী তাকে যা বলেন তার মর্মার্থ, ‘‘তুই তো চাঁদ বেনের পুজো নিয়ে ছাড়লি, মা। এ বার ওই ধনার সর্বনাশের ব্যবস্থা কর। দু’টো সাপ পাঠিয়ে দে, ব্যাটা মরুক বিষের জ্বালায়।’’
নীরেনবাবু ভোটের কথাও বলছিলেন, ‘‘এই যে দেবদেবীরা মানুষের পূজাপ্রার্থী, এটি আজকের নেতাদের ভোটপ্রার্থনার মতো।’’ রামকুমার তাঁর বক্তৃতায় বলছিলেন, গাঁ-ঘরের আর পাঁচ জনের মতো তিনিও ভূত, অপদেবতা ইত্যাদি দেখেছেন। কিন্তু লক্ষ্মী পদ্মফুলের ওপর বসে হাতি গিলছেন, সেই কমলেকামিনী দেখার সৌভাগ্য হয়নি তাঁর। পাঁচতারা হোটেলে, বৈশাখী দ্বিতীয়ার সন্ধ্যায় কমলেকামিনী না দেখার আক্ষেপ! প্রায় দু’শো বছর আগে, ১৮১৫ সালে হিন্দুদের ইতিহাস, পুরাণ ইত্যাদি নিয়ে ওয়ার্ড নামে এক খ্রিস্টান মিশনারি একটি বই লিখেছিলেন। পাদরিসাহেব জানিয়েছিলেন, বৈশাখ মাসের অষ্টমী তিথিতে কমলেকামিনী পুজো হয়। সপ্তদশ শতকের সেই পুজো আজ আর নেই। কখনও কখনও দেবদেবীরাও বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যান!
হারিয়ে যাওয়াটাই সব নয়। কিছু জিনিস হারিয়ে যায়, শূন্যস্থান পূরণ করতে চলে আসে নতুনরা। নীরেন্দ্রনাথ যেমন বললেন, ‘‘আজকাল ধামাকা, হাঙ্গামা বলে নতুন দু’টি বাংলা শব্দ শুরু হয়েছে। এই হাঙ্গামা মানে দাঙ্গা বা মারপিট নয়। উত্তমরূপে বিক্রিবাটা। শব্দটি আদতে বাংলা নয়, কিন্তু জনরুচি ওটিকে গ্রহণ করেছে।’’ কোন শব্দ থাকবে, আর কোনটা থাকবে না, সেটি জনরুচির ওপর নির্ভরশীল।রামকুমার জনরুচির সেই চলতি হাওয়ার পন্থী নন। প্রচুর লেখেননি, পাঁচ বছর ধরে একটি উপন্যাস নিয়েই পড়ে আছেন। আর মঙ্গলকাব্যের চর্চায় প্রায় ‘কোয়ার্টার সেঞ্চুরি’ অতিক্রান্ত। প্রধান সম্পাদক তাঁর ভাষণে রামকুমারের সেই নিষ্ঠার কথা বলছিলেন। ‘‘তিনি দীর্ঘদিন ধরে গভীর নিষ্ঠায় একটি যুগকে জেনেছেন, তার সঙ্গে একাত্ম হওয়ার চেষ্টা করেছেন।’’ এই সযত্ন তন্নিষ্ঠ মনোভাব আজকের বাঙালি জীবনে বিশেষ দেখা যায় না। সেই বিরল নিষ্ঠাই শনিবার সন্ধ্যায় আনন্দ পুরস্কারে সম্মানিত।
নিষ্ঠা বিরল, কিন্তু বাঙালির অদেখা নয়। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী এবং রামকুমার মুখোপাধ্যায় দু’জনের মুখেই এ দিন শোনা গেল প্রয়াত সুকুমার সেনের নাম। তাঁর সনিষ্ঠ সম্পাদনা আজও তুলনাহীন। ঘটনাচক্রে ‘চণ্ডীমঙ্গল’ই সেই তুলনাহীনতার উদাহরণ। বিভিন্ন পুঁথির পাঠান্তর মিলিয়ে মুকুন্দরামের ‘চণ্ডীমঙ্গল’ সম্পাদনা করেছিলেন সুকুমার সেন। আজও নীরেন্দ্রনাথ থেকে রামকুমার সকলেই ওই সংস্করণকে মডেল ভাবেন। সাতের দশকে ওই চণ্ডীমঙ্গল সম্পাদনা করতে গিয়ে সুকুমার সেন আদর্শ পাঠ ধরেছিলেন ১৭১৭ সালের একটি পুঁথিকে। হুগলি জেলার মোকাম রাধানগর পরগণার ‘শ্রীজুত কিত্তিচন্দ্র রায়ে’র পুঁথি ছিল সেটি। সম্পাদক দেখিয়েছিলেন, এই কিত্তিচন্দ্র আর কেউ নন, রামমোহন রায়ের প্রপিতামহ কৃষ্ণচন্দ্র রায়। রেনেসাঁর পথিকৃতের জীবনেই ছিল মঙ্গলকাব্যের উত্তরাধিকার।
শনিবারের পুরস্কার-সন্ধ্যা সেই বঙ্গীয় উত্তরাধিকারকেই নতুন করে তুলে আনল বিভ্রান্তির গহন তল থেকে। |