পুস্তক পরিচয় ১...
এমন পরিক্রমা বাংলায় নেই
দ্য প্রভিন্স অব দ্য বুক/ স্কলার্স, স্ক্রাইব্স, অ্যান্ড স্ক্রিবলার্স ইন কলোনিয়াল তামিলনাড়ু, এ আর বেঙ্কটচলপতি। পার্মানেন্ট ব্ল্যাক, ৭৯৫.০০
দিনেমার বণিকরা ১৬২০ খ্রিস্টাব্দে আস্তানা গাড়ে তামিলভাষী অঞ্চল তরঙ্গমবাড়িতে। ১৭১২ সালে লুথারপন্থী ধর্মপ্রচারক বার্তোলোমেউস জিগ্নবাল্গ ও তাঁর অনুগামীরা সেখানে ছাপাখানা চালু করেন। অষ্টাদশ শতকে শুধু এখান থেকেই ছাপা হয় প্রায় ৩৩৮টি বই। ইয়োরোপের বাইরে রোমক হরফ ব্যবহার না করে এত বেশি বই সম্ভবত আর কোথাও ছাপা হয়নি। অন্তত দক্ষিণ এশিয়ার ভূখণ্ডে তামিল ছাপা বইয়ের বনেদিয়ানা সম্পর্কে সংশয়ের কোনও অবকাশই নেই।
অথচ তরঙ্গমবাড়ির অনতিদূরে তিরুভবদুতুরাই মঠে বাস করতেন শিবজ্ঞান মুনিবর, যিনি ১৭৮৫-তে ৩২ বছর বয়সে দেহত্যাগ করেন। মুনিবরের মহাগ্রন্থ, শৈব সিদ্ধান্ত সম্প্রদায়ের মান্য ব্যাখ্যা ‘শিবজ্ঞান ভাষ্য’, একশো বছরের উপর মঠেই লুকিয়ে রাখা হয়। ১৯০৬-এ এর দু’টি অসম্পূর্ণ সংস্করণ ছাপা হয়, এবং ১৯২১-এ প্রকাশিত হয় মুতুকুমারস্বামী তাম্বিরানের গোপনে নকল করা পাণ্ডুলিপি।
ছাপাখানার প্রসারে এই আপাতবৈপরীত্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এ আর বেঙ্কটচলপতি তাঁর তামিল গ্রন্থ সম্পর্কিত শ্রমসাধ্য গবেষণায়। গ্রন্থনামের উত্তরভাগে ‘স্কলার্স, স্ক্রাইব্স, অ্যান্ড স্ক্রিবলার্স’ শব্দক’টি আছে বটে, কিন্তু লেখকের কালপর্ব তামিলনাড়ুতে মুদ্রণযন্ত্র আসার পরেই। উপরে বর্ণিত যে-কূটাভাসের প্রসঙ্গটি তুলেছেন, তার মূলে রয়েছে ভারতে খুসনবিশ-মুন্সিদের সাংস্কৃতিক গুরুত্ব ও পেশাগত তাগিদ এমনটাই মনে হয়েছে তাঁর। এ দেশের গ্রন্থেতিহাস চর্চায় মুদ্রণের অহেতুক প্রাধান্য নিয়েও তর্ক তুলেছেন বেঙ্কটচলপতি।
প্রশ্নগুলির গুরুত্ব বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। বেঙ্কটচলপতি চাইছেন ছাপাখানার প্রযুক্তির ক্রমিক অগ্রগতির ইতিবৃত্তের বদলে প্রকাশনার ‘বস্তুবাদী’ আখ্যান নির্মাণ করতে। এখানে মুশকিল হল ‘মেটেরিয়াল প্র্যাকটিস’ জাতীয় সমাজবিজ্ঞানের অভ্যস্ত বুলির নেপথ্যে কাজ করে একটি প্রাতিষ্ঠানিক মননচর্চার রীতি ও চৌহদ্দি বেঁধে দেওয়ার হানিকর চেষ্টা। ঠিক কোন ‘প্র্যাকটিস’-টি লেখকের বিদ্যাচর্চার জগতে ‘মেটেরিয়াল’ নয় জানতে সাধ হয়। অভিনবত্বের কথা বললেও এই গবেষণা ডার্নটন বর্ণিত লেখাপড়ার বৃত্ত ধরেই এগিয়েছে পোষকতা, গ্রাহকভিত্তিক প্রকাশনা থেকে বাজার, উচ্চমার্গীয় গ্রন্থ থেকে হেটো বই, লেখক-মুদ্রক-প্রকাশকের ভূমিকার ক্রমবিভাজন, রাজনৈতিক খবরদারি ও রুচির নির্মাণ, পাঠক্রিয়ার স্তরভেদ, সাক্ষরতা ও পাঠাগারের বিস্তার।
প্রতি বৃত্তাংশের আলোচনাতেই লেখক বেছেছেন কয়েকটি প্রাসঙ্গিক নজির। এগুলির বিশ্লেষণ গ্রন্থের সব চাইতে মূল্যবান দিক। পোষ্টার মুখাপেক্ষী লেখক ও সাংবাদিক সুব্রহ্মণ্য ভারতী কী রাজনৈতিক নির্বন্ধে জনতার কবি হয়ে উঠলেন, উপন্যাস পাঠ কেন মেয়েলি আলস্যযাপনের সমার্থক হয়ে উঠল, গুজিলি (বা কুচিলি) এলাকার সস্তা প্রকাশনা কেমন নিম্নরুচির দ্যোতক হয়ে দাঁড়াল (এখানে বটতলার তুলনা কিছুটা হলেও ভ্রান্তিপ্রসূত), যৌথ পাঠ ও নিঃসঙ্গ নীরব পাঠের পথ যে ভাবে ভিন্ন হয়ে গেল এ হেন প্রশ্নের অনুধাবনে বইটি ভারতীয় গ্রন্থচর্চায় একটি দৃষ্টান্ত বলে গণ্য হবে।
সমস্যা হল, ‘বস্তুবাদী’ আচারের নিরীক্ষার শেষ কোথায়, আর গ্রন্থেতিহাসের প্রতিষ্ঠানিক এক্তিয়ারই বা কী জিনিস এ বিষয়ে ধন্দ থেকেই যায়। মেনে নেওয়া গেল, কেবল ছাপার কথা ভাবলে ইতিহাস ব্যাখ্যায় সামঞ্জস্য থাকে না, প্রযুক্তিগত নির্ধারণবাদের শিকার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। কিন্তু হরফ ঢালাইয়ের প্রযুক্তি তো গুটেনবার্গের আগেও ছিল, স্বর্ণকাররা তা ব্যবহারও করত। কিন্তু ভেড়া বা বাছুরের ছালে মুদ্রণকর্ম অর্থনৈতিক কারণে পোষাত না। সস্তা কাগজ আসার পরেই পাশ্চাত্যে ছাপার প্রসার সম্ভব হয়। ভারতে দিনেমারদের সাফল্যের পিছনে ছিল তাদের কাগজকল, ঠিক যেমন ছাপার কাজে গোয়ায় পর্তুগিজদের ব্যর্থতার মূলে ছিল কাঁচা মালের অভাব। ভারতবর্ষে কাগজ অমিল ছিল না, অভাব ছিল সস্তায় ভূরি উৎপাদনের।
গ্রন্থে এ সব প্রসঙ্গ না থাকলেও অনুমান করি গ্রন্থকার এগুলিকে তাঁর ডিসিপ্লিনের গণ্ডিতে ঠাঁই দেবেন। কিন্তু পাঠতত্ত্বের গর্হিত অনুপ্রবেশ উনি মেনে নেবেন তো? প্রায় এক দশক আগে প্রকাশিত অভিজিৎ গুপ্ত এবং আমার সম্পাদিত একটি বইয়ের এক প্রবন্ধের সমালোচনায় বেঙ্কটচলপতি মুদ্রণপ্রসূত হরফ, ভাষা ও পাঠক্রিয়ার সাংকর্য, সে সম্পর্কে উৎকণ্ঠা, বাংলা গদ্যরীতি ও জনপরিসর নির্মাণে তার অভিঘাত ইত্যাদি প্রসঙ্গগুলিকে গ্রন্থেতিহাসের ‘প্রভিন্স’-বহির্ভূত বলে তাচ্ছিল্য করেছিলেন। এই সংকীর্ণতার ফল কী হতে পারে তা আলোচ্য বইটিতেই প্রকট। শৈব সিদ্ধান্ত সম্প্রদায়ের মুদ্রণবিরোধিতা বা মহাভারতের তামিল তর্জমাকার মানালুর বীরস্বামী রামানুজাচারীর (১৮৬৬-১৯৪০) শোচনীয় আর্থিক বিপর্যয় তাঁর বৃত্তান্তে বিচার্য নমুনা হিসাবেই রয়ে গিয়েছে, সামগ্রিক প্রতিপাদ্যে সাঙ্গীকৃত হতে পারেনি। হতে পারত যদি তিনি পাঠতত্ত্বের স্পর্শ এড়াতে এত কাতর না হতেন।
একই ভাবে পাঠবিশারদদের পাণ্ডিত্যের সঙ্গে লেখ্য সংস্কৃতির নিবিড় ও রক্ষণশীল যোগ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। নামপত্রের ডিজাইন ও ছবির বিবর্তন খেয়াল করা হয়েছে, কিন্তু প্রযুক্তি ও প্রসঙ্গের সাপেক্ষতা বিচার করা হয়নি। রবার্ট ডার্নটন বা বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন বা রজে শার্তিয়ে-র তত্ত্ব প্রয়োগে লেখক যতটা উৎসাহী, স্ট্যানলি মরিসন এবং ডন ম্যাকেঞ্জি-র মতো ‘বস্তুবাদী’ পাঠতাত্ত্বিকদের পথে হাঁটতে ততটা নন। অন্তত ‘স্ক্রাইব’ সংক্রান্ত আলোচনায় স্ট্যানলি মরিসনের কাজ এবং আখ্যাপত্রের বিবর্তন ও টাইপোগ্রাফির বিচারে নিকোলাস বার্কার প্রভৃতির উল্লেখ বইটির মান বাড়াত।
তবু বলব, বইটি ভারতীয় গ্রন্থচর্চার সাম্প্রতিক ইতিহাসে এক উজ্জ্বল সংযোজন। ভারতীয় প্রকাশকরা আর্কাইভের ধার ধারেন না, অমূল্য নথিপত্র অলস হাতে ফেলে দেন। ফলে ভারতীয় বইয়ের ইতিহাস রচনা দুরূহ কাজ। বইয়ের মুদ্রণসংখ্যা থেকে দাম সারণিবদ্ধ করে একটি আকরগ্রন্থ রচনা করেছেন লেখক। খেদের কথা, এমন একটি ব্যাপক প্রসঙ্গের পরিক্রমা বাংলা গ্রন্থেতিহাস চর্চায় নেই। থাকলে আমরা বেঙ্কটচলপতির সঙ্গে বিস্তৃত সংলাপের সুযোগ পেতাম।
উদাহরণ দেওয়া যাক। লেখক তামিল নবজাগরণের তত্ত্বটিকে প্রশ্ন করেছেন। এই তত্ত্ব অনুযায়ী ছাপার দৌলতে ঊনবিংশ শতকের শেষে ধ্রুপদী তামিল সাহিত্য পুনরাবিষ্কৃত হয়। সে আন্দোলন আবার ব্রাহ্মণ্যবাদ-বিরোধী সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ অনুপ্রাণিত করে। লেখকের প্রশ্ন, তা হলে ঊনবিংশ শতকে দামোদরম পিল্লাইকে কেন মুদ্রণ-পরবর্তী ব্যাকরণ ‘ইলক্কানা বিলক্কম’ গ্রন্থটির তালপাতার পুথি আঁতিপাতি করে খুঁজতে হবে? ষোড়শ শতাব্দীর শেষে ছাপাকল দাক্ষিণাত্যে এসে পৌঁছনোর তিনশো বছর পর কেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় তামিল বই ছাপা হবে?
বাঙালি পাঠকের অবধারিত ভাবে মনে পড়বে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধ ‘বাঙ্গালার ইতিহাস সম্বন্ধে কয়েকটি কথা’ যেখানে বাংলার নবজাগরণের লগ্ন নির্দিষ্ট হয়েছিল ‘নবদ্বীপে চৈতন্যচন্দ্রোদয়’-পরবর্তী সময়ে, ছাপাখানা আসার ঢের আগে। মনে পড়বে, বঙ্কিমের ‘লোকশিক্ষা’ প্রবন্ধ যেখানে ‘বঙ্গদর্শন’-এর পত্রসূচনায় লেখক বাংলায় মুদ্রণপ্রসূত জনসংস্কৃতি সম্পর্কে কার্যত হাল ছেড়ে দেবেন। পক্ষান্তরে, মুদ্রণ পরবর্তী বাংলা পুনর্জাগরণ নিয়ে ‘বাঙ্গালা সাহিত্য: বর্তমান শতাব্দীর’ প্রবন্ধে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর আশ্বাসবাণী মনে পড়বে।
এমন সংলাপ বাঞ্ছনীয়। যা বাঞ্ছনীয় ছিল না তা হল মুখবন্ধে ভারতীয় গ্রন্থবিদ্যাচর্চায় লেখকের নিজেকে পথিকৃৎ হিসাবে প্রতিপন্ন করার অপচেষ্টা। ভারতীয় ভাষায় যা লেখা হয়েছে তা সবটা না জানলেও এবং কেশবন-প্রিয়লকারের একরৈখিক ইতিহাস উপেক্ষা করলেও লেখক ইংরেজি ভাষায় সুকুমার সেন থেকে সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজকে তাঁর বিদ্যাচর্চার চৌহদ্দি থেকে নির্বাসিত করলেন, এ প্রায় অভাবনীয়। আমি নিশ্চিত তামিল গ্রন্থের ইতিহাস সম্পর্কেও এমন বহু কাজ প্রকীর্ণ অবস্থায় রয়েছে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.