মনোরঞ্জন ১...
মানিকের সন্ধানে
কেউ কারও প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন না। আজও নন।
বৃষ্টিভেজা সকাল। সত্যজিৎ রায়ের সন্ধানে তিন চরিত্র। তাঁর ছবিরই তিন নায়ক ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়, দীপঙ্কর দে আর বরুণ চন্দ। সত্যজিৎ রায়ের জন্ম বা মৃত্যুবার্ষিকীতে এঁরা কেউই আর বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িতে যান না। সবারই এক কথা। গেলেই কেমন মনে হবে জায়গাটা ফাঁকা। ওই শূন্যতাটা আজ ভাল লাগে না।
বহু বছর পরে এঁদের তিন জনের আবার দেখা।
জায়গাটা বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়ি নয়। রেসকোর্স। যেখানে বছর তেতাল্লিশ আগে সত্যজিৎ রায় শ্যুটিং করেছিলেন ‘সীমাবদ্ধ’।
সাদা-নীলের কলকাতা শহরটা আজ অনেকটাই পাল্টে গিয়েছে। পাল্টায়নি রেসকোর্সটা। “ওই যে দেখছেন ঘড়িটা...ওটা তখনও ছিল,” বরুণ বলেন। তার পর ধৃতিমান আর দীপঙ্করকে সঙ্গে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলেন বক্সগুলোর দিকে। নীচে সাদা বেঞ্চ, বৃষ্টিতে ভেজা। রেসকোর্স খালি। বিস্তৃত ট্র্যাকের সামনে দাঁড়িয়ে শুরু হল ফিরে দেখা...
রয়্যাল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাবে ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়, দীপঙ্কর দে ও বরুণ চন্দ। ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল

‘সীমাবদ্ধ’র শ্যুটিঙে ফাইন
বরুণ: প্রথম বার শ্যুটিং করতে এসেছিলাম ১৯৭০য়ের ডিসেম্বরে। শর্মিলার সঙ্গে। কিন্তু অনেক টাকা খেসারত দিতে হয়েছিল। তখনকার রেওয়াজ ছিল পরিচালক বা ক্যামেরা ইউনিটের লোক না হলে কেউ লেন্স দিয়ে লুক থ্রু করতে পারবেন না। আমি অত জানতাম না। রেসকোর্সটা দারুণ সুন্দর লাগছিল দেখতে সে দিন। লেন্সে চোখ রেখেছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরা অ্যাসিস্টেন্টরা এসে বললেন জরিমানা দিতে হবে। তখনকার দিনে একশো টাকা জরিমানা। শ্যুটিঙের সময় আমি নিজে থেকেই একটা সানগ্লাস নিয়ে এসেছিলাম। মনে হয়েছিল সানগ্লাসটা হয়তো রেসের মাঠে ভাল লাগবে। মাঝখানে আমি সানগ্লাসটা খুলে শর্মিলাকে দিয়ে দিই। এটা স্ক্রিপ্টে ছিল না। মানিকদার এটা দারুণ লেগেছিল।

দীপঙ্কর: তাই নাকি। জানতাম না তো!
সীমাবদ্ধ
বরুণ: ‘সীমাবদ্ধ’তে তোমার ছোট্ট রোলটা মানিকদার খুব পছন্দ হয়েছিল। বলেছিলেন, ‘ছেলেটা ভাল।’

দীপঙ্কর: তাই? অনেকেই জানেন না যে সুন্দর (ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়) আর আমি একই ক্লাসে সেন্ট জেভিয়ার্সে পড়তাম। ১৯৬১ সালে পাশ করেছিলাম। তবে তখন মনে হয়নি যে অভিনয় করব। এক বছর বাংলায় রচনার প্রতিযোগিতা হল। তাতে সুন্দর প্রথম হয়ে সোনার মেডেল পেয়েছিল।

ধৃতিমান: রচনাটার বিষয় ছিল ‘ও নদী বল কোথায় তোমার দেশ?’ পরের বছর রচনা প্রতিযোগিতায় দীপঙ্কর ফার্স্ট।

দীপঙ্কর: প্রেসিডেন্সিতেও একসঙ্গে দু’জনে পড়েছি।

বাংলা বলতে পারো?
ধৃতিমান: প্রেসিডেন্সি কলেজের পর আমি দিল্লি চলে যাই। ওখানে ফিল্ম সোসাইটির মুভমেন্টের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। তখন শ্যাম বেনেগলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। মানিকদাকেও। ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ হওয়ার আগে আমার কিছু ঘনিষ্ঠজন বলেছিলেন ওঁর সঙ্গে দেখা করতে। তখন মানিকদা লেক টেম্পল রোডে থাকতেন। বাড়িতে থাকলে সব সময় নিজেই দরজা খুলতেন। দেখা করার পরে কথা প্রসঙ্গে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘বাংলা বলতে পারো তো?’

দীপঙ্কর: তোমাকে এটা জিজ্ঞেস করেছিলেন? আর আমি যে দিন প্রথম ওঁর কাছে যাই, শুনি এক ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করছেন, ‘ইংরেজি বলতে পারো তো?’ মানিকদাই একমাত্র মানুষ যাঁর কাছে আমি নিজের জন্য রোল চেয়েছিলাম। আর আমাকে পার্টটা দিয়ে বলেছিলেন, ‘একটা ছোট রোল আছে, চলবে?’ ভেবে দ্যাখো... আমার হাত পা প্রায় সেঁধিয়ে যাচ্ছে। আর মানিকদা আমায় জিজ্ঞেস করছেন রোলটা আমার ‘চলবে’ কি না!

বরুণ: সুন্দরকে মানিকদার রোলটার জন্য পছন্দ হয়েছিল ঠিক। তবে ওঁকে বলতে শুনেছি, ‘ছেলেটা খুব চুপচাপ। স্বল্পভাষী’। অডিশনের সময় বলেছিলেন একটা ভায়োলেন্সের শট করে দেখাতে। ওই যে শটটা ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’তে আছে। টেবিল উল্টে ফেলার শট। সেটা নাকি সুন্দর এত ভাল করেছিল যে তার পর আর কোনও সন্দেহ ছিল না কারও মনে। আসলে সেই সময় রায়বাড়িতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ঘরের ছেলে। ওঁকে রোলে নিলে সবাই নিশ্চিন্ত।

ধৃতিমান: তবে অনেকেই জানেন না যে ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ দিয়েই বরুণের রুপোলি পর্দায় অবতরণ।

বরুণ: আমার মুখটা দেখানো হয়নি বলে অনেকে অনেক কথা বলেছিলেন। তাঁদের কথা অনুযায়ী মানিকদা তখনই ঠিক করেছিলেন যে আমাকে ‘সীমাবদ্ধ’তে নেবেন। তাই মুখটা দেখাননি। কিন্তু আমি এটা জানতাম না।

দীপঙ্কর: আচ্ছা সেই কৃষ্ণা বসু বলে এক জন অভিনেত্রীর কথা মনে আছে? ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’-তে ছিলেন। স্ক্রিন প্রেজেন্স ভাল ছিল। কিন্তু গুজব শুনেছি বহু বার টেক দিতে হত ওঁকে।

বরুণ: আমিও শুনেছি। ছবিটা দেখলে বোঝা যায় না।

গণশত্রু প্রতিদ্বন্দ্বী
পুলু, তুমি অভিনয়টা এ ভাবে করো
ধৃতিমান: মানিকদার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে অবজার্ভ করেছি যে উনি অভিনয় করানোর ক্ষেত্রে দু’ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। অনেককে একদম ছেড়ে দিতেন। আর কিছু অভিনেতাকে স্টেপ বাই স্টেপ দেখিয়ে দিতেন।

দীপঙ্কর: ‘শাখাপ্রশাখা’ করতে গিয়েও দেখেছি কী ভাবে সৌমিত্রদাকেও মানিকদা দেখিয়ে দিতেন। ওই ডাইনিং রুমের সিনটা মনে আছে? আমার মনে আছে উনি অভিনয় করে দেখিয়ে দিয়ে বলছেন, ‘পুলু, তুমি অভিনয়টা এ ভাবে করো...’

ধৃতিমান: কেন, ছবি বিশ্বাস? ওঁর সঙ্গীতবোধটা কম ছিল। ‘জলসাঘর’ করার সময় শুনেছি মানিকদা এ ভাবেও ইন্সট্রাকশন দিয়েছেন: ‘আপনি বসে আছেন। অমুক সময়ে একটা টোকা দেবেন।’ পরে মিউজিকটা ওই শটের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হত। আমার ধারণা মানিকদা সব সময় স্ক্রিপ্টের ফাইনাল ড্রাফ্টটা মুখ্য চরিত্র নির্বাচন করে তার পরে লিখতেন। তাতে কাজটা অনেক বেশি সরল হয়ে যেত।

বরুণ: অনেকে জিজ্ঞাসা করেছেন কোনও দিন সৌমিত্রদাকে অন্যান্য অভিনেতারা হিংসে করতেন কি না। কেন ওঁর বারবার ডাক পড়েছে আর অন্যদের পড়ছে না। আমরা জানতাম যে মানিকদার ছবিতে আমাদের রোল থাকলে ডাক আসবেই।

ধৃতিমান: সৌমিত্রদা ইজ অ্যান ইন্সটিটিউশন। আজও ওঁর কী এনার্জি! দারুণ স্মৃতিশক্তি। গোটা ‘তোতাকাহিনি’টা একবারে আবৃত্তি করে দিতে পারেন। আর ওঁর ‘সেন্স অফ হিউমিলিটি’। ‘পদ্মভূষণ’ পাওয়ার পরে এক বার ওঁর সঙ্গে একটা কাজ করতে গিয়েছি। উইংসে আমরা দাঁড়িয়ে। কোনও চেয়ার নেই। কোথা থেকে সৌমিত্রদা একটা চেয়ার টেনে নিয়ে এলেন। একবার প্রোগ্রাম থেকে ফিরছি। গাড়ি পাওয়া যাচ্ছে না। সৌমিত্রদা বললেন, ‘আমি একটা ট্যাক্সি নিয়ে নিচ্ছি!’ এই ভাবনাটাই তো হারিয়ে গেছে। সৌমিত্রদার মধ্যে কোনও দিন স্টার হওয়ার প্রবণতা দেখিনি। এখন তো কোন অভিনেতা ‘ইনোভা’ চড়ল সেই নিয়েই আলোচনা। আমরা তো ঝরঝরে অ্যাম্বাস্যাডার চড়েই শ্যুটিং করতে গেছি। সেটাও আবার সব্বাইকে তুলতে তুলতে আসত।
মানিকদার ভয়েই কাঁপুনি
দীপঙ্কর: মানিকদার ‘জনঅরণ্য’র প্রথম শট। সত্যদার ডায়লগ ‘ভোম্বল এটা কী করে হয়?...’ সেটা শুনে আমার কী হল জানি না, হঠাৎ অদ্ভুত একটা কাঁপুনি দিতে শুরু করল। মনে হল যেন নিউমোনিয়া হয়েছে। কেন যে অমন হল জানি না। কিছু দিন পরে নার্ভাসনেসটা কেটে গিয়েছিল। তবে মাঝখানে অনেক দিন গ্যাপ ছিল মানিকদার সঙ্গে আবার কাজ করার। ওঁকে এটা নিয়ে কোনও দিন জিজ্ঞেস করিনি। এক বার এক অভিনেতার স্ত্রীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। উনি আমায় জানান যে মানিকদা নাকি বলেছিলেন আমি ‘ওভার এক্সপোজড’। তাই কাজে ডাকেন না। তবে এই কথাটা কত দূর সত্যি আমি জানি না...

বরুণ: আমি এটা শুনিনি। তবে প্রথম দিকে মানিকদা চাইতেন যে প্রত্যেক ছবিতে নতুন অভিনেতাদের নিতে। যাঁদের জেনুইনলি চরিত্রতেই মানিয়ে যেত।

দীপঙ্কর: যখন ‘গণশত্রু’ তৈরি হয় প্রথমে উনি আমাকে একেবারে একটা ব্ল্যাক ক্যারেকটার করবেন বলে ঠিক করেছিলেন। তার পর ভেবেছিলেন যে আমার চরিত্রের প্রতি দর্শকের সমবেদনা থাকা দরকার। ছবিটা প্রথমে সাদা কালোয় করার কথা হয়েছিল। পরে কালারে শিফ্ট হয়।

ধৃতিমান: আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম ‘গণশত্রু’তে আমার কাস্টিং নিয়ে। মানিকদার সঙ্গে কাজ করাটা বেশ সহজ ছিল। সেটে গিয়ে শট দেওয়া। ব্যস। এখন তো অভিনয় করতে গেলে শুনি কত ওয়ার্কশপ করতে হয়। আমি ওসব ওয়ার্কশপ করিনি।

চারুলতা
গুজব ছিল, রাজ কপূরের হিংসে নিয়ে
দীপঙ্কর: সুন্দর, আমি শুনেছিলাম ‘গণশত্রু’তে তোমার ওই রোলটা প্রথমে অন্য এক জন অভিনেতার করার কথা ছিল। তিনি নাকি আন্তর্জাতিক স্বত্ব চেয়েছিলেন বলে শেষ পর্যন্ত কাস্টিংটা হয়নি।

ধৃতিমান: আই ওয়াজ দ্য সেকেন্ড চয়েজ। মানিকদা অন্য কাউকে চেয়েছিলেন। কিন্তু কোনও কারণবশত সেটা হয়নি। আমার ওই চরিত্রে কাজ করাটা একটা প্রিভিলেজ। উনি একজন কমপ্লিট ফিল্মমেকার। ‘গণশত্রু’তে আমার কী রকম স্কার্ফ হবে সেটাও উনি ঠিক করে দিয়েছিলেন। নিজের স্কার্ফটাও দিয়েছিলেন আমাকে পরার জন্য। এক বার মনে আছে শ্যুটিং করছি। লম্বা ডায়লগের পরেও দেখেছি মানিকদা কিছু বলছেন না। জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘মানিকদা ঠিক হয়েছে?’’ মানিকদা বললেন, “ভুল হলে বলে দেব।”

দীপঙ্কর: আরে আমাকেও এই একই কথা বলেছিলেন। আর বলতেন, “কিছু মুখস্থ করবে না। জলের মতো হয়ে যাবে।” এক সময় গুজব রটেছিল যে রাজ কপূর নাকি চেয়েছিলেন যে তাঁর এক ছেলে যেন মানিকদার ছবিতে অভিনয় করে। কিন্তু মানিকদা রাজি হননি। তার ফল? শুনেছিলাম ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ রাজ কপূর কায়দা করে বসিয়ে দিয়েছিলেন। তখনকার দিনে বম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির লোকেরা বুঝেছিলেন যে যদি ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’র মতো কম বাজেটের ভাল ছবি দর্শকের পছন্দ হয় তা হলে ওদের অন্যান্য ছবির হাল খারাপ হয়ে যাবে। সেই একই জিনিস নাকি হয়েছিল উত্তমকুমারের ‘ছোটিসি মুলাকাত’য়ে।

কিশোরকুমার, সত্যজিৎ রায়
মৃণালদা বনাম মানিকদা
বরুণ: মৃণালদা আর মানিকদার তো কত লড়াই হয়েছিল পত্রপত্রিকাতে। তবে তখনকার ভাল বাণিজ্যিক ছবির পরিচালকরা মানিকদার থেকে বেশির ভাগই ‘আনইনফ্লুয়েন্সড’ থাকতেন।

ধৃতিমান: সত্তর থেকে আশির দশকে ফিল্ম কালচারটাই আলাদা ছিল। পত্রপত্রিকাতে সমালোচনা হত। তকর্র্ হত। যাঁরা সমালোচনা করতেন তাঁদের কথায় আমরা আমল দিতাম। যেমন চিদানন্দ দাশগুপ্ত, শান্তি চৌধুরী প্রমুখ। সিনেমা নিয়ে অনেক সিরিয়াস কথা হত, শুধু সেলিব্রিটি ওয়ারশিপ নয়।

দীপঙ্কর: ‘ইন্টারভিউ’ মুক্তি পাওয়ার পর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কী তর্ক! এক দল মৃণালদার ছবির সমর্থক। এক দল মানিকদার।

ধৃতিমান: দুটো দলের মতাদর্শের যে পার্থক্য, তার ভিত্তিটা ছিল রাজনৈতিক বিশ্বাস।

বরুণ: সুন্দর, মৃণালদা আর মানিকদা দু’জনের বাড়িতেই কী ভাবে তোমার অবারিত দ্বার ছিল?

ধৃতিমান: দেখো, আমি এঁদের দু’জনের সঙ্গেই ছবি করতে চেয়েছিলাম যাতে এঁদের ফিল্ম মেকিং-এর স্টাইলটা জানতে পারি। দু’জনের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও দু’জন দু’জনের ছবি দেখতেন।

বরুণ: কলকাতার ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলন শুরুর সময় তো দু’জনেই ছিলেন।

ধৃতিমান: মৃণালদা আমাকে বলেছিলেন ‘অপরাজিত’ হল মানিকদার সব চেয়ে সমকালীন ছবি।

বরুণ: আমার মনে হয় সুন্দরের মধ্যে একটা এলিমেন্ট অব ইমপারশিয়ালিটি ছিল। একটা অ্যালুফনেস ছিল।

ধৃতিমান: আমি সে অর্থে ইন্ডাস্ট্রির লোক ছিলাম না। বিশপ লেফ্রয় রোড দিয়ে যাচ্ছি। এক বার দেখতাম জানলাটা খোলা আছে কি না। খোলা আছে মানে উনি আছেন বাড়িতে। চলে যেতাম। তার পর গপ্প-আড্ডা হত। তবে এমনও হয়েছে যে হয়তো আমার সামনেই এঁদের কেউ অন্যের ছবির ত্রুটি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তবে আমি সে সময় কথা বলতাম না। আমি কোনও দিন কারও ওপর নিজের মতটা আরোপ করে দেওয়াতে বিশ্বাসী নই।

সুচিত্রা সেনের সঙ্গে ‘দেবী চৌধুরাণী’ করতে চেয়েছিলেন
বরুণ: শুনেছিলাম ‘দেবী চৌধুরাণী’ ছবিতে সুচিত্রা সেনের অভিনয় করার কথা ছিল। কিন্তু সে আমলেও উনি নাকি ২ লক্ষ টাকা চেয়েছিলেন।

দীপঙ্কর: আমরা যখন মানিকদার ছবিতে কাজ করেছি তখন কেউ টাকার কথা ভাবতেই পারিনি। তবে সুচিত্রা সেন তো স্টার। আমি তো উত্তম-সুচিত্রা ছবির জন্য পাগল ছিলাম।

বরুণ: বিমলার চরিত্রের জন্যও তো বেশ কিছু মহিলার সঙ্গে কথা হয়েছিল। রিনাও ছিল তার মধ্যে। কিন্তু শুনেছি কথা বলার পর পর রিনা গট প্রেগনেন্ট। শান্তিনিকেতনের একটি মেয়েকে মানিকদার তো দারুণ ভাল লেগেছিল ওই চরিত্রটির জন্য। ‘অশনি সঙ্কেত’য়ের শ্যুটিং চলছিল। ‘ঘরে বাইরে’ শুরু করতে তখনও দেরি। মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেল। তার শ্বশুর বাড়িতে সিনেমা করায় আপত্তি ছিল।
কিশোরকুমারের ‘চিনি গো চিনি ...’ এক টেকে ওকে ছিল


দীপঙ্কর: মানিকদার মতো ভাল ফিল্ম মিউজিক কেউ বুঝতেন না। মানিকদা তো সব সময় আঁকাআঁকি করতেন। কিছু কিছু আঁকা দেখে আমার মনে হয়েছে যে, ওঁর হয়তো রবিশঙ্করকে নিয়েও কোনও কাজ করার ইচ্ছে ছিল।

বরুণ: এটা জানতাম না।

দীপঙ্কর: শুনেছিলাম কিশোরকুমারকে দিয়ে যখন মানিকদা আমি ‘চিনি গো চিনি...’ রেকর্ড করছিলেন, সেটা ওয়ান টেকে ওকে ছিল। তার পরও কিশোরকুমার বলেছিলেন, ‘মানিকমামা, আমি আরেক বার রেকর্ড করতে চাই’। দ্বিতীয় টেকে নাকি হেসে ঠোঁট চওড়া করে গেয়েছিলেন।

রবিশঙ্করের সঙ্গে
বরুণ: একটা দু’টো ভাল কাজ হচ্ছে। কিন্তু যেহেতু ভ্যাকুয়াম বলে কিছু হবে না, তাড়াতাড়ি তাই কাউকে ধরে এনে একটা বিশাল পরিচালক বা অভিনেতা বানানো হচ্ছে। তার যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও এটা করা হচ্ছে। মিডিয়া ইজ ক্রিয়েটিং গ্রেটনেস।

দীপঙ্কর: বেসিক কনটেন্ট-এর অভাব। এখনকার বেশির ভাগ ছবিতে শুধুমাত্র চালিয়াতি। প্রচুর খামতি। টেকনিক্যাল ইমপ্রুভমেন্ট হলেই তো সব হয় না। এই তো সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘হেমলক সোসাইটি’তে অভিনয় করলাম। একটা বা দু’টো টেক হলে ঠিক আছে। গোটা সিনটাকে আট-দশ বার টেক করা হল। ক্যামেরাটা বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে বসিয়ে। রূপা (গঙ্গোপাধ্যায়) আর আমি ছিলাম। শেষে রূপা সহ্য করতে না পেরে সৃজিতকে বলেছিল, “ইউ আর ট্রিটিং আস লাইক প্রপস অন দ্য সেটস”! তবুও তো সৃজিত রি-টেক করে। সিরিয়ালে তো নব্বই ভাগ পর্ব পরিচালকরা টেক করতেই জানেন না। ভাগ্যিস উত্তমকুমার আজকে বেঁচে নেই! ওঁকে সিরিয়াল করতে হয়নি। উত্তমকুমার থাকলে সুইসাইড করতেন।

উত্তমদা আমার ডায়লগ কেটে দেবেন
দীপঙ্কর: এক বার পরিচালক দিলীপ মুখোপাধ্যায় আমাকে ‘স্নো-ফক্স ক্যাবারে’ বলে একটা ছবিতে উত্তমদার সঙ্গে অভিনয় করতে বলেন। আমি হঠাৎ বলে বসলাম, “আমি করব না। উত্তমকুমার ডায়ালগ কেটে দেবেন।” খুব স্বাভাবিক ভাবেই উত্তমদা আমার ওপর রেগে গেলেন। মাঝখানে ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ করা নিয়ে একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল আমার সঙ্গে। উত্তমদা রোলটা প্রিপেয়ার করার সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন। শ্যুটিং আটকে যায়। বারুইপুরে একটা বিশাল বাগান তৈরি করা হয়েছিল শ্যুটিংয়ের জন্য। শুনেছিলাম উত্তমদা সেরে ওঠা অবধি অপেক্ষা করলে বাগানটা শুকিয়ে যেত। হঠাৎ আমার কাছে তপন সিংহ’র ডাক এল। আমি দারুণ খুশি। কিন্তু যখন শুনলাম যে রোলটা আগে উত্তমদার করার কথা ছিল, আমি বলেছিলাম যে আমি এক বার ওঁর সঙ্গে কথা বলে নিতে চাই। তপনদা বলেছিলেন সেটার দরকার নেই। উনি সামলে নেবেন। সেই থেকেই ভুল বোঝাবুঝির শুরু। মামলা হয়েছিল। তবে বত্রিশ বছর বয়সে ওই রকম একটা চরিত্র করা কঠিন ছিল। আজকালকার অনেক বত্রিশ বছরের অভিনেতাদের চ্যালেঞ্জ করে বলছি একটা বাঞ্ছারাম করে দেখাক। উত্তমদার অভিমান হয়েছিল। আর ওই যে ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ করলাম, তার পর থেকে আমাকে ভিলেন হিসেবে স্ট্যাম্প করে দেওয়া হল টালিগঞ্জে। শেষ দিকে উত্তমদার সঙ্গে সম্পর্কটা ভাল হয়েছিল। চলে যাওয়ার আগে আমাকে দু’টো কথা বলেছিলেন, “জীবনে বোম্বেতে গিয়ে আমার মতো ভুলটা করিস না।’’ আর বলেছিলেন, “ব্রাহ্মণ সন্তান হয়ে বলছি, তুই অনেক দূর যাবি।”

ধৃতিমান: আমি সব সময় বলি দীপঙ্কর আমাদের জেনারেশনের সব চেয়ে গিফ্টেড অভিনেতা। এই প্রসঙ্গে মমতাশঙ্কর আর অনসূয়া মজুমদারের নামও করব।

দীপঙ্কর: কিন্তু সে রকম চরিত্র কোথায় পাই? ‘আবহমান’ করলাম। আমি তো মনে করি যে ওটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ। ‘শাখাপ্রশাখা’ বা ‘বাঞ্ছারামের বাগান’য়ের থেকেও ভাল অভিনয় করেছিলাম ওখানে। তবে জাতীয় পুরস্কারের মনোনয়নের জন্য পাঠানোই হয়নি। এতে অবশ্য ঋতুপর্ণর কোনও হাত ছিল না। আজকাল তো নন-অ্যাক্টিংটাকে নর্ম্যাল অ্যাক্টিং বলে চালানো হচ্ছে। আর সেটায় মদত দিচ্ছে মিডিয়া। কিছু নন-অ্যাক্টরস করে খাচ্ছে। ঠোঁটকাটা বলে আমার বদনাম আছে। আমি কাউকে ছোট না করেই বলছি যে আমার সমবয়সিদের চেয়ে আমি অনেক ভাল অভিনেতা। কিন্তু তার মধ্যে অনেকে আমার থেকে অনেক বেশি জনপ্রিয়। যেমন ধরুন রঞ্জিত মল্লিক। উনি উত্তমবাবুর প্রিয় শিল্পী ছিলেন। প্রচুর ছবি করেছেন একসঙ্গে।

বরুণ: আগেকার দিনের ছবির কথা হচ্ছিল। এই ধরুন ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’। খুব বড় মাপের ছবি তো নয়। কিন্তু কী উপভোগ্য ছবি। আজকাল সব দেখি স্টাইল সর্বস্ব ছবি।

দীপঙ্কর: এক জন পরিচালক আছেন। বীরসা দাশগুপ্ত। ওর স্টাইল নাকি ক্যামেরাটা শুধু দোলানো। ক্রেডলের মতো। তবে সৃজিতের একটা ভাল গুণ আছে। ও যে ভাবে অভিনয়টা করে দেখাতে পারে, সেটা খুব ভাল। ঠিক কোথায় পজ দিতে হবে, কোথায় কী ভাবে তাকাতে হবে দারুণ সুন্দর বলে দিতে পারে ও। খুব কম পরিচালকের এই গুণটা আছে। আর পারেন ঋতুপর্ণ ও বাবু (সন্দীপ রায়)।

তবু আশার আলো দেখি
ধৃতিমান: বাংলা ছবিকে যে দর্শক একেবারে বর্জন করেছিলেন, তাঁরা হলে ফিরছেন। ‘শব্দ’র মতো ছবি হচ্ছে আজকাল। টেরিফিক ফিল্ম। খুব ভাল লেগেছে আমার। যেটা আমার অসুবিধে হচ্ছে সেটা হল, আগে কাজ করার সময় আমরা পরিচালককে দেখতে পেতাম। এখন শ্যুটিং হয় এক জায়গাতে। আর পরিচালক প্রায় ছত্রিশ কিলোমিটার দূরে। আগেকার দিনে যাঁরা ছবি বানাতেন, যেমন মানিকদা, মৃণালদা বা ঋত্বিক ঘটক, তাঁদের মধ্যে একটা রাজনৈতিক সচেতনতা ছিল। এখনও পশ্চিমবঙ্গে একটা রাজনৈতিক উত্তাল সময়। কিন্তু সিনেমাতে তার প্রতিফলন আমি দেখতে পাই না। তার অবশ্য অন্য কারণ থাকতে পারে। আগেকার ডিরেক্টররা ওয়্যার অ্যালাউড টু ফেল। এক্সপেরিমেন্ট করতে পারতেন তাঁরা। এখন ইউ আর নট অ্যালাউড টু ফেল।

দীপঙ্কর: এত পরিমাণ টাকা এখন সিনেমাতে ঢালা হয় যে, ঝুঁকিটা অনেক বেড়ে গিয়েছে। এই তো সে দিন শুনলাম এক পরিচালকের ছবি থেকে কুড়ি মিনিট কাটতে হচ্ছে। এটা কোনও প্রযোজক কি মানিকদাকে বলতে সাহস পেতেন? কাটা দূরের কথা, প্রযোজক এটা বলতেই সাহস পেতেন না।

ধৃতিমান: দিনগুলোই পাল্টে গিয়েছে। আমি বিশ্বাস করি না যে আগের সব ভাল, আর এখন সব খারাপ। আজকালকার দিনে স্যাটেলাইট রাইটস বিক্রিটা খুব জরুরি। রাজনৈতিক মতামত প্রকাশ করার প্ল্যাটফর্ম এখন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট।

বরুণ: হঠাৎ মনে হল আজ যদি এই আড্ডাতে মানিকদা থাকতেন? কী বলতেন উনি? আমার মনে হয় না আজ থাকলে উনি অন্যদের সিনেমা নিয়ে আলোচনা করতেন। হয়তো আড্ডার বিষয় হত কী পড়ছি আমরা।

ধৃতিমান: উনি হয়তো বলতেন ফিল্মস গেট মেড অ্যাকর্ডিং টু সারকামস্ট্যানসেস অব দ্য টাইম।

দীপঙ্কর: মনে পড়ছে ‘আগন্তুক’-এ আড্ডা নিয়ে সেই সংলাপটা? ‘সক্রেটিসও আড্ডা মারতেন। বাট ইট ওয়াজ আড্ডা অ্যাট দ্য হায়েস্ট লেভেল’। আমরা এখানে সেটাই করার চেষ্টা করছি। পরনিন্দা, পরচর্চা হয়তো একটু আধটু এসে গিয়েছে। মানিকদা আজ থাকলে বলতেন: ‘হ্যাঁ চালিয়ে যাও। যথার্থ সিনেমা নিয়ে আরও আলোচনা করো।’

ছবি: নিমাই ঘোষ


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.